কাজী মারুফ হোসেন সাতক্ষীরা:
‘একজন প্রকৃত মুসলমান সে-ই, যার হাত ও মুখ থেকে অন্যরা নিরাপদ থাকে।’ কতই না চমৎকার ও সম্প্রীতির শিক্ষা আমাদের প্রিয় নবি ও শ্রেষ্ঠ নবি (সা.)-এর। আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে যখন মহানবি (সা.) নবি হওয়ার ঘোষণা করলেন এবং আরববাসীকে একমাত্র আল্লাহর দিকে আহ্বান করলেন, তখন তাঁর (সা.) কিছু আত্মীয়, গরিব ও ক্রীতদাসসহ তাদের মধ্যে যারা বুদ্ধিমান ছিলেন, তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন। যখন তাদের প্রচার বৃদ্ধি পেল, তখন মক্কার কাফেরদের নিষ্ঠুরতা এমন মাত্রায় বাড়ল যে, তারা বিশ্বাসীদের আরবের তপ্ত বালুর ওপর শুইয়ে দিয়ে তাদের বুকের ওপর গরম পাথর চাপিয়ে সেঁক দিল, বেত্রাঘাতে জর্জরিত করা হলো তাদের, হাত-পা উটের সঙ্গে বেঁধে উটকে বিপরীত দিকে চালিয়ে তাদের দেহ ছিন্নভিন্ন করা হলো।
মহানবি (সা.) এবং তার প্রতি অনুগত ও বিশ্বস্ত লোকদের একটি পাহাড়ের উপত্যকায় নির্বাসিত করে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য অথবা পানীয় সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো। এতে নবি করিম (সা.)-এর সঙ্গীরা বলতে লাগলেন, তারা তো এমনিতেই মারা যাবেন, তবে কেন যুদ্ধ করে পাহাড়ের নিচে নামবেন না? মূলত এসব মুসলমানও তো ওইসব লোকের মধ্য থেকেই এসেছিল যারা মামুলি কারণে পরস্পরকে হত্যা করত এবং রক্তপাত ঘটাত কিন্তু যখন কেউ বলত ‘আমাদের যুদ্ধ করার অনুমতি দিন’ তখন মহানবি (সা.) বলতেন, সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাকে যুদ্ধ করার আদেশ দেননি। অবশেষে মহানবি (সা.) নির্যাতিত কিছু লোককে হিজরত করার অনুমতি দান করেন এবং এর কিছু দিন পর তিনি নিজে মদিনায় হিজরত করেন। সে সময় মদিনা শহরের কিছু অধিবাসীও মুসলমান হয়েছিল। তাঁর (সা.) আগমনে মদিনায় প্রচুর সংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করেন।
নবি করিম (সা.) মদিনার অন্যান্য ধর্ম ও গোত্রের লোকদের সঙ্গে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হন এবং তাদের মধ্যে ইহুদিরাও ছিল। তিনি (সা.) সেখানে একটি রাষ্ট্র কায়েম করলেন যেখানে সব প্রজাসাধারণের স্বাধীনতা ছিল। যদি কাউকে কোনো অপরাধের জন্য সাজা দেওয়া হতো, তবে সে সাজা তাদের নিজ ধর্মের আইনের আলোকেই দেওয়া হতো। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ভিন্ন ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রের সব প্রজারা সমান অধিকার ভোগ করত। এসব সত্ত্বেও মহানবি (সা.)-এর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উত্থাপন করা হয় তা হচ্ছে- (নাউযুবিল্লাহ) তিনি (সা.) সন্ত্রাস বিস্তার করেছেন। যা ইসলামবিরোধীদের একটি মহামিথ্যা আপত্তি। প্রশ্ন হলো, মুসলমানদের অসহায় অবস্থায় নিষ্ঠুরভাবে অত্যাচারিত হওয়ার বিষয়টি সবার জানা থাকা সত্ত্বেও মুসলমানদের প্রাণপ্রিয় নবি (সা.)-এর বিরুদ্ধে এরূপ আপত্তি ওঠার কারণ কী?
চরম বিপদের অবস্থায় যখন মুসলমানরা মদিনায় হিজরত করল এবং পারস্পরিক আত্মীয়সুলভ ব্যবহারের মাধ্যমে শান্তিতে বসবাস করতে লাগল, সেখানেও মক্কাবাসীরা শিকারি কুকুরের মতো তাদের পশ্চাদ্ভাবন করে আক্রমণ করল। এভাবে সংঘটিত প্রথম যুদ্ধ ‘বদরের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। সে সময় মুসলমানদের অবস্থা এরূপ ছিল যে, তাদের সম্পদ ছিল সামান্য, যুদ্ধের সরঞ্জামও ছিল খুবই কম। অপরদিকে তাদের বিরুদ্ধে ছিল পূর্ণভাবে সজ্জিত এক সেনাদল। এ অবস্থা কারও অজানা নয় এবং ইতিহাসে তা লিপিবদ্ধ আছে। মুসলমানদের ওইসব অদক্ষ-অনভিজ্ঞ লোকেরা কী করতে পারত? তাদের মধ্যে কতক ছিল মাত্র তেরো থেকে উনিশ বছর বয়সি। যা হোক, যখন শত্রু সেনাদল মুসলমানদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে উদ্যত হলো, সর্বশক্তিমান আল্লাহ তখন মুসলমানদের যুদ্ধ করার নির্দেশ দিলেন, যে বিষয়ে পবিত্র কুরআনের নিুোক্ত সূরা নাজিল হয় এবং ইতিহাসবিদদের মতে এটাই হচ্ছে প্রথম নির্দেশ, যা যুদ্ধের বিষয়ে নাজিল হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ করার জন্য প্রদত্ত এ অনুমতির পেছনে যে সৌন্দর্য ও উদ্দেশ্য বর্ণিত হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, ‘ওইসব লোকদের যুদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো হয়েছে, কারণ তাদের বিরুদ্ধে অন্যায় করা হয়েছে। তাদের সাহায্য করার শক্তি আল্লাহর রয়েছে। যাদেরকে তাদের নিজ গৃহ থেকে অন্যায়ভাবে বিতাড়িত করা হয়েছে শুধু এ কারণে যে, তারা বলে, আল্লাহ আমাদের প্রভু। এবং যদি আল্লাহ কিছু লোককে অপর কিছু লোক দ্বারা হটিয়ে না দিতেন তবে তারা মঠ, গির্জা, ইহুদি উপাসনালয় এবং মসজিদগুলো, যে সবের মধ্যে প্রায়শ আল্লাহর নাম স্মরণ করা হয়ে থাকে, সেগুলো উৎপাটন করে ফেলা হতো। আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করে যে আল্লাহকে সাহায্য করে। বস্তুত আল্লাহ হচ্ছেন প্রবল ক্ষমতাবান, প্রচণ্ড শক্তিশালী’ (সূরা আল হজ, আয়াত : ৩৯-৪০)। আল্লাহ বলেন, যদি প্রতিরক্ষার অনুমতি দেওয়া না হতো তাহলে সমাজে শান্তি বিনাশ হতো। আজকের দিনে কোনো বিবেকবান ব্যক্তি তা সে যে ধর্মের অনুসারীই হোন না কেন, সে হয়তো বলবে যে, যুক্তির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করাই বৈধ। এর প্রথম কারণ হচ্ছে, কেউ আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ করার অধিকার তার রয়েছে। দ্বিতীয়ত কারও কৃত জুলুমের কারণে কেউ যদি হিজরত করতে বাধ্য হয় অথবা অন্যায়ভাবে যদি কিছু লোককে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়িত করা হয় এবং তারপরও শিকারি কুকুরের মতো পশ্চাদ্ভাবন করে তাদের নিজ দেশে শান্তিতে বসবাস করতে দেওয়া না হয়, তখন তাদের ক্ষতি পূরণের জন্য প্রতিশোধ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত। তৃতীয়ত অত্যাচারীরা প্রথম তাদের লক্ষ্যবস্তুতেই সমীবদ্ধ রাখে না, তাদের লোভ বৃদ্ধি পায় এবং বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারা এ বিষয় বিবেচনা করে না যে, কে কোন ধর্মাবলম্বী। তারা সবাইকে নিঃসঙ্গ করতে চেষ্টা করে। সুতরাং এটাই যথেষ্ট। নিষ্ঠুরতা প্রতিহত করার জন্য এ অমঙ্গলকে অঙ্কুরেই বিনাশ করা জরুরি হয়ে পড়ে। সুতরাং যুদ্ধের এ অনুমতি ছিল আত্মরক্ষা ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য। অতঃপর যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া হলো, তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে পবিত্র কুরআনে সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেন, ‘এবং যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তাদের বিরুদ্ধে তোমরা আল্লাহর খাতিরে যুদ্ধ কর কিন্তু সীমালঙ্ঘন করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করেন না’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ১৯০)। এ কথা স্পষ্ট যে, জিহাদের নির্দেশ কেবল ওইসব লোকদের বিরুদ্ধে ছিল, যারা ধর্মের কারণে যুদ্ধ করেছিল এবং ধর্মান্তরিত করতে চেয়েছিল, যা মক্কায় ঘটেছিল। মক্কার অবিশ্বাসীরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে ইসলাম ধর্মের যবনিকা টানতে চেয়েছিল। মহানবি (সা.) ছিলেন শান্তির মূর্ত প্রতীক। মানবের প্রতি মহানবি (সা.)-এর যে ভালোবাসা ছিল, তা তার জীবনের কয়েকটি ঘটনা নিয়ে আলোচনা করলেই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। তাঁর (সা.) তায়েফ গমনের ঘটনা সর্বজনবিদিত। আল্লাহতায়ালার তৌহিদ প্রচারের লক্ষ্যে তিনি তায়েফ নগরীতে গমন করেন। মহানবি (সা.) ভাবলেন, তায়েফবাসী হয়তো বা তাঁর কথায় কান দেবে। কিন্তু আল্লাহতায়ালার তৌহিদের বাণী তায়েববাসীরা শোনা তো দূরের কথা, বরং তাঁর ওপর অমানবিক জুলুম অত্যাচার করল। তায়েববাসীরা বখাটেদের তাঁর পেছনে লাগিয়ে দেয় এবং তারা পাথর নিক্ষেপ করে তাঁর জ্যোতির্ময় পবিত্র দেহকে রক্তাক্ত করে দেয়। আত্মরক্ষার্থে মানব দরদি রাসূল দ্রুতপদে তায়েফ ত্যাগ করেন। তিনি যখন তায়েফের উপকণ্ঠে পৌঁছেন তখন আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে ফেরেশতা এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি যদি চান, তাহলে এ জালিম শহরবাসীদের আল্লাহ তাদের পাপের দরুন ধ্বংস করে দেবেন।’ ফেরেশতার কথার জবাবে মানবপ্রেমী রাসূল আল্লাহতায়ালার দরবারে দুহাত তুলে এ দোয়াই করলেন, ‘হে আল্লাহ! তারা অজ্ঞ, তাই আমার ওপর জুলুম করেছে। তুমি এদের ক্ষমা কর এবং হেদায়াত দাও।’ হায়! কি মহানই না ছিলেন আমার প্রিয় নবি ও বিশ্বনবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.)।
নবুওয়ত লাভের পর মক্কি জীবনে তিনি (সা.) ও তাঁর সাহাবিরা (রা.) যে পৈশাচিক জুলুম-নির্যাতনের স্বীকার হয়েছিলেন, তার ইতিহাস আমরা সবাই জানি। আবু জাহল ও আবু লাহাবের দল তার ওপর জঘন্য শারীরিক নির্যাতন চালিয়েছিল। প্রায় তিন বছর তাকে (সা.) ও সাহাবিদের নির্বাসিত জীবনযাপন করতে হয়েছিল। বহু নিরপরাধ মুসলমানকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল। অবশেষে জালিমদের জুলুম নির্যাতনে মহানবি (সা.) প্রিয় মাতৃভূমি মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় চলে গেলেন। যেদিন তিনি মহাবিজয়ীর বেশে মক্কায় প্রবেশ করেন, সেদিন মক্কাবাসীরা ভেবেছিল, আজ নিশ্চয়ই তাদের রক্ষা নেই। তারা ভয়ানক শাস্তির প্রতীক্ষা করছিল। কিন্তু মানব দরদি ও শ্রেষ্ঠ রাসূল সবাইকে অবাক করে সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করলেন। নবি (সা.) যুদ্ধক্ষেত্রেও কোনো শিশু ও বৃদ্ধকে হত্যা করতে বারণ করেছেন। রণাঙ্গনে ভুলক্রমে কোনো ইহুদি শিশু মারা গেলে হুজুর পাক (সা.) সাহাবিদের প্রতি অসন্তুষ্ট হন।
লেখক: জেলা সাংবাদিক এসোসিয়েশন সাতক্ষীরা এর সিনিয়র যুগ্ন- সাধারণ সম্পাদক কাজী মারুফ হোসেন।
Leave a Reply