কাজী মারুফ হোসেন সাতক্ষীরা: দারিদ্র্য ও অভাব সমস্যা সমাধানে উদাহরণস্বরূপ অনেক পন্থার মধ্যে শুধু একটি পন্থার কথা উল্লেখ করা যায়, যেটা ‘উমর (রা.) অবলম্বন করেছিলেন। তিনি মদিনার নিকটবর্তী ‘রাবযাহ’ নামক একখণ্ড জমি সরকারি মালিকানায় আনলেন, যাতে মুসলিমদের গবাদিপশু চরতে পারে। কিন্তু তিনি সরকারি মালিকানায় আনাই যথেষ্ট মনে করলেন না। বরং তিনি দরিদ্র অসহায়দের এবং কম আয়ের মুসলিমদের অধিকারকে অগ্রাধিকার দিলেন। যাতে তারা বিনা ব্যয়ে চারণভূমিকে নিজেদের গবাদি সম্পদ ও আয় বৃদ্ধির মাধ্যম বানিয়ে নিতে পারেন এবং সরকারের কাছে কোনো ধরনের সাহায্য সহযোগিতা না চান। এ উদ্দেশ্যে তিনি চারণভূমিটির তত্ত্বাবধায়ক হুনাই-এর প্রতি নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, হে হুনাই, মানুষের সঙ্গে নরম ব্যবহার এবং মজলুমের দুয়াকে ভয় কর। কেননা, তাদের দুয়া কবুল করা হয়। কম উট এবং কম বকরির মালিকদের চারণভূমিতে প্রবেশের অনুমতি দেবে। ইব্ন আফফান ও ইব্ন আওয়াফের গবাদিপশু ধ্বংস হয়ে গেলে তারা নিজেদের অন্য খেত এবং খেজুরের বাগানের দিকে ফিরিয়ে নেবে।
অর্থাৎ তাদের কাছে অন্য সম্পদ এবং জীবিকার অন্যান্য মাধ্যম রয়েছে। আর এসব মিসকিনের (কম উট এবং বকরির মালিক) গবাদিপশু ধ্বংস হয়ে গেলে নিজের সন্তানসন্ততি নিয়ে আমার কাছে এসে চিৎকার দিয়ে বলবে, ‘হে আমীরুল মুমিনিন। আমি কি সন্তানদের পরিত্যাগ করব? আমি কি তাদের বাবা নই? তাদের ধনসম্পদ সরবরাহ করার চেয়ে তাদের পশুর ঘাস সরবরাহ করা আমার পক্ষে সহজ’।
মুসলিম সরকারের জন্য আবশ্যক যে, সব কম সম্পদ ও কম আয়ের নাগরিকদের প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রাখা এবং তাদের জন্য এমন সুযোগ সৃষ্টি করা, যাতে তারা কাজ করে রোজগার করে এবং স্বাবলম্বী হয়ে যেতে পারে। এ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যদি ধনী ও বিত্তশালীদের উন্নয়নের প্রশ্নটি খাটোও করতে হয় এবং তাদের সম্পদ লাভের ও আয়ের কিছু কিছু মাধ্যম থেকে বঞ্চিতও করতে হয় এবং তাদের আয় বৃদ্ধি ও উন্নয়ন বিঘ্নত হয়, তাহলে তাই করতে হবে।
ইসলামে খলিফার দায়িত্ব শুধু এতেই সীমাবদ্ধ নয় যে, ধনসম্পদ, মানুষের অধিকার ও রাষ্ট্রের স্বাধীনতাকে অভ্যন্তরীণ এবং বাইরের হামলা থেকে হিফাজত করবে; বরং তার দায়িত্বের পরিধি আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত। বস্তুত ইসলামে খলিফা বা রাষ্ট্রপ্রধান হলেন পরিবারের পিতা বা অভিভাবকের মতো। এজন্যই রাসূলুল্লাহ (সা.) হাদিসে তাদের উভয়কে একত্রিত করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককে নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। শাসক বা খলিফা জাতির দায়িত্বশীল এবং নিজের প্রজা সম্পর্কে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। আর ব্যক্তি তার পরিবারের দায়িত্বশীল তাকে তার পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে।
‘উমর (রা.) বলতেন, ফোরাত নদীর তীরে একটি উটও যদি অযতেœ মারা যায়, তাহলেও আমার ভয় হচ্ছে, আল্লাহ হয়তো আমার কাছে এর কৈফিয়ত চাইবেন। যদি একটি প্রাণীর ব্যাপারে খলিফার দায়িত্ব এটা হয়, তাহলে আশরাফুল মাখলুকাত মানুষের ব্যাপারে তার দায়িত্ব কত বেশি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ঐতিহাসিকরা ‘উমর ইব্ন আব্দুল আযিয (রহ.) সম্পর্কে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তার স্ত্রী ফাতিমা বলেন, একদিন তার কাছে গেলাম, দেখলাম তিনি জায়নামাজে বসে আছেন এবং তার হাত তার গালে, তার দুগাল বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে। তার এ অবস্থা দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কাঁদছেন কেন? জবাবে তিনি বললেন : ‘আমি এ গোটা উম্মতের ওপর দায়িত্বশীল নিযুক্ত হয়েছি। ক্ষুধার্ত দরিদ্র, নিঃস্ব, রোগী, চেষ্টাক্লিষ্ট নগ্ন ব্যক্তি, অভিভাবকহারা ইয়াতিম, উপায়হীন বিধবা, পরাভূত মজলুম, অপরিচিত বন্দি, স্বল্প আয় ও বেশি সন্তান পালনে দায়িত্বশীল এবং ইসলামি রাষ্ট্রের সীমার মধ্যে দূরদূরান্ত ও চতুর্দিকে অবস্থিত এ ধরনের লোকদের কঠিন দুরবস্থার কথা আমার মনে তীব্রভাবে জেগে ওঠে। আমি জানি, আল্লাহ এদের সম্পর্কে আমাকে নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করবেন। রাসূল (সা.)ও এদের সম্পর্কে আমার কাছে কৈফিয়ত চাইবেন। আমি ভয় পাচ্ছি, এ ব্যাপারে আমার কোনো ওজরই হয়তো আল্লাহতায়ালা কবুল করবেন না, রাসূলে করিম (সা.)-এর কাছেও হয়তো আমার কোনো যুক্তি খাটবে না। হে ফাতিমা, আল্লাহ্র শপথ! এ চিন্তার তীব্রতায় আমার দিল আকুল হয়ে উঠেছে, অন্তর ব্যথিত, দুঃখ-ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। আর আমার দুচোখ তপ্ত অশ্রুর ধারা প্রবাহিত করছে। ওই অবস্থার কথা আমি যত বেশি স্মরণ করি, আমার ভয় ও আতঙ্ক ততই তীব্র হয়ে ওঠে। এজন্য আমি কাঁদছি’। বস্তুত ইসলাম যে রাষ্ট্রপ্রধানের ওপরই সব মানুষের প্রয়োজন পূরণের ও নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব অর্পণ করে, এ তারই বহিঃপ্রকাশ ও অকাট্য প্রমাণ।
ইসলামে দারিদ্র্য বিমোচনে বায়তুল মালের ভূমিকার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত হলো ‘উমর (রা.)-এর যুগের এ ঘটনাটি : ‘একদা উমর (রা.) এক অমুসলিম অন্ধ বৃদ্ধকে ভিক্ষা করতে দেখে তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘তুমি কোন আহলে কিতাবের অন্তর্ভুক্ত?’ সে বলল, ‘আমি একজন ইয়াহুদি। ‘উমর (রা.) বললেন, ‘তুমি ভিক্ষা করছ কেন?’ ‘সে বলল, আমার কাছে জিযিয়া তলব করা হচ্ছে, অথচ তা পরিশোধ করার সামর্থ্য আমার নেই। ‘উমর (রা.) তার হাত ধরে নিজের ঘরে নিয়ে এলেন। প্রথমে নিজের কাছ থেকে (তাকে) কিছু সাহায্য দিলেন, অতঃপর বায়তুলমালের খাজাঞ্চিকে ডেকে নির্দেশ দিলেন, ‘তার এবং তার মতো লোকদের (শোচনীয়) অবস্থা দেখ এবং তার জন্য বায়তুলমাল থেকে কিছু নির্ধারণ কর এবং তার ও তার মতো লোকদের কাছ থেকে জিযিয়া আদায় কর না। আল্লাহ্র কসম, এটা কোনো ন্যায়বিচার নয় যে, আমরা এসব লোকের যৌবনকাল থেকে ফায়দা (উপকার) লুটব, কিন্তু বার্ধক্যকালে তাদের বাইরে নিক্ষেপ করব।
Leave a Reply