মোঃ ফরিদ উদ্দিন শ্যামনগর: দেশে প্রতিদিন শত শত বাল্যবিবাহের কারণে ঝরে পড়ছে হাজারো সম্ভাবনাময় ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যৎ। সংশ্লিষ্ট পক্ষ যতই কঠোর হচ্ছে, অপরাধীরা ততই চতুরতার আশ্রয় নিচ্ছে। ফলে বাল্যবিবাহ সমাজে এক বিষফোঁড়া হয়ে টিকে যাচ্ছে। আর করোনা মহামারিতে এ বিষফোঁড়া আরও বেশি ফুলেফেঁপে উঠেছে। করোনাকালে দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকায় অর্থনৈতিকভাবে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তা বাল্যবিবাহের গতির পালে হাওয়া দিতে অন্যতম নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছে । করোনাকালে বাল্যবিবাহ, পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা, ডিভোর্স, আত্মহত্যা সংখ্যা বেড়েছে।
এগুলোও বাল্যবিবাহের জন্য দায়ী। বর্তমানে বাল্যবিবাহে বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থান চতুর্থ। সংখ্যার দিক থেকে আমরা ভারতের পরেই অবস্থান করছি। দেশের প্রায় ৫১ শতাংশ কন্যাসন্তান বাল্যবিবাহের শিকার। গেল দুই বছরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশে ৫৯ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে এবং ২২ শতাংশ মেয়ের ১৫ বছরের আগে। কিন্তু করোনাকালে ১৩ শতাংশ বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর মূল কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা এবং কর্মসংস্থানের সংকটের কারণে তৈরি হওয়া অভাবের কারণে গ্রামীণ পরিবারগুলো একরকম ঝুঁকির মুখে পড়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের মতো অন্যান্য দেশেও লকডাউন থাকায় প্রবাসী শ্রমিকরা দেশে ফিরছে, বিয়ে করছে। আর পরিবারগুলো মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি বেশি আগ্রহী হচ্ছে।
লকডাউনে লোক সমাগম নিষিদ্ধ থাকায় বিয়ের খরচ কম হচ্ছে, এর সুযোগ নিচ্ছে দরিদ্র পরিবারগুলো। অন্যভাবে দেখলে, খরচের দিক থেকে লাভবান হচ্ছে দুই পরিবারই। শুধু তাই নয়, যেসব পরিবার করোনাকালে জীবিকার সংকটে নাজেহাল, তারাও অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে সন্তানদের বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাইছে।
বাংলাদেশ প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নতি করছে। অবকাঠামোগত, চিকিৎসাসেবা, শিল্প, কর্মসংস্থান ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই। চলমান করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণেও বাংলাদেশ এগিয়ে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সফলতা গণটিকা কার্যক্রম। এ মুহূর্তে কয়েক ধরনের কোভিড-১৯ টিকা প্রদানের মাধ্যমে গণটিকা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এ সংক্রান্ত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানেও সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
মোদ্দা কথা, করোনা মোকাবিলায় সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে। কিন্তু এসবের মধ্যেও নানা সংকট ডানা মেলেছে। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের ৮৫ শতাংশই প্রান্তিক কৃষক, তাদের মধ্যে পর্যাপ্ত শিক্ষার অভাব রয়েছে, সচেতনতার অভাব রয়েছে। গ্রাম ও শহরে করোনা মহামারিতে জীবন ও জীবিকার সংকট রয়েছে।
কর্মসংস্থানের খোঁজে গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষ মহামারিতে জীবিকার সংস্থান করতে না পারায় পরিবার নিয়ে গ্রামে ফিরে আসছে। এসব মোকাবিলায় সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছে, প্রণোদনা দিচ্ছে। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশের পরও দেশের কিছু কিছু স্থানে প্রণোদনার অর্থ সঠিকভাবে দেওয়া হচ্ছে না বলে আমরা সংবাদ পাচ্ছি। উপরের সবগুলো বিষয়ই কোনো না কোনোভাবে বাল্যবিবাহকে উৎসাহিত করে।
করোনাকালে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা গবেষণার মাধ্যমে বাল্যবিবাহের প্রকৃত চিত্রটি তুলে ধরেছে। ব্র্যাক জানাচ্ছে, ৮৫ শতাংশ অভিভাবক উল্লেখ করেছেন, করোনাকালে জীবিকার সংকট থাকায় তারা সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছে। এ কারণে তারা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই কন্যাসন্তানের বিয়ে দিতে আগ্রহী। ৭১ শতাংশ জানিয়েছে, স্কুল খোলায় অনিশ্চয়তা থাকার এবং করোনা মহামারি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কায় অনিরাপত্তাবোধে বাল্যবিবাহের প্রতি ঝুঁকছে। ৬২ শতাংশ জানিয়েছে, প্রবাসী ছেলে সহজেই পেয়ে যাওয়ায় তারা কন্যাসন্তানদের ১৮ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য জরিপ জানাচ্ছে, ৩ বছর ধরে দেশে বাল্যবিবাহের হার বেড়েছে। তবে শিশুদের নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রতিবেদনে বাল্যবিবাহ সম্পর্কে যে তথ্য উঠে এসেছে, তা মনকে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো। বলা হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী এ মুহূর্তে ৫ লাখ মেয়ে বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে আছে, যার মধ্যে ২ লাখ দক্ষিণ এশিয়ায়। প্রায় ১০ লাখ বাল্যবিবাহের শিকার হওয়া অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের সন্তানসম্ভবা হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে।
করোনার কারণে ২০২৫ সাল নাগাদ বাল্যবিবাহের সংখ্যা বেড়ে ২ কোটিতে পৌঁছতে পারে বলেও মনে করছে সংস্থাটি। সম্প্রতি প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে কোভিড-১৯ ও বাল্যবিবাহের সম্পর্ক নিয়ে।
করোনাকালে দেশের প্রতিটি জেলায় এর হার বেড়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাকালে নিবন্ধিত বিয়ে কমছে; বাড়ছে অনিবন্ধিত বিয়ের সংখ্যা, যার মূলত পুরোটাই বাল্যবিবাহ।
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের সর্বশেষ গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রায় ৭৭ শতাংশ মানুষ ছেলেমেয়ের বিয়ে দেওয়ার ন্যূনতম বয়সের ব্যাপারে অবগত। ৮৫ শতাংশ বাল্যবিবাহকে সমর্থন করে না এবং ৯৬ শতাংশ বিশ্বাস করে, বাল্যবিবাহ বন্ধ হওয়া জরুরি। প্রশ্ন আসে, বাল্যবিবাহের কারণে আমরা কী ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছি? আমরা যদি একটু তৃণমূল পর্যায় থেকে চিন্তা করি; বাল্যবিবাহ সংঘটিত হওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে।
অর্থনৈতিক অভাব, শিক্ষার অভাব, যৌতুক প্রথা, ইভটিজিং, অনিশ্চয়তা, অনিরাপত্তা, যৌন নির্যাতন-এসব বিষয় বাল্যবিবাহে প্রভাবক হিসাবে কাজ করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক হওয়ায় দেশে নারীশিক্ষার প্রসার বেড়েছে। কিন্তু শুধু শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নতি হলেও বাকি বিষয়গুলোর কারণে নারীদের ভবিষ্যৎ যাত্রা অনেকাংশেই মুখ থুবড়ে পড়ছে।
বাল্যবিবাহের সবচেয়ে বড় সমস্যা স্বাস্থ্যঝুঁকি। বাল্যবিবাহের সঙ্গে প্রজনন স্বাস্থ্য ও বয়ঃসন্ধির সম্পর্ক রয়েছে।
Leave a Reply