ন্যাশনাল ডেস্ক: সেহেরির সময় ডাকাডাকি একটি বাঙালী সংস্কৃতি। ইসলামে রয়েছে এর জোরালো সমর্থন। এই ঐতিহ্যকে আশ্রয় দেয়া ইসলামের অনন্য সৌন্দর্য। তাই সেহেরির ডাকাডাকিকে নিছক আহ্বান মনে করা ভুল। এটি ধর্মীয় কল্যাণকামিতারও বটে।
রোজা রাখার উদ্দেশে সেহেরি খাওয়া নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। তিনি নিজে সেহেরি খেতেন। সাহাবায়ে কেরামকেও সেহেরির জন্য ডাকতেন। ইমাম আবু বকর ইবনে আবি শায়বা রহ. তার মুসান্নাফ গ্রন্থে আবু রুহম সামায়ি রহ. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি ইরবাদ ইবনে সারিয়া রা.-কে বলতে শুনেছি, রাসূল সা. আমাদেরকে রমজানে সেহেরির জন্য ডাকতেন। তিনি বলতেন, বরকতময় ভোররাত। মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নম্বর ৮৭২১, আস-সুনানুল কুবরা, হাদিস নম্বর ২৪৫৪, শরহু মুশকিলিল আসার, হাদিস নম্বর ৪৮৪১, সুনানে নাসায়ি, হাদিস নম্বর ২২৬৫, সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নম্বর ২০০০, মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নম্বর ১৬৮১২, মুজামুল কবির হাদিস নম্বর ১৫০৫০, সহিহ ইবনে খুযায়মা, হাদিস নম্বর ১৮৩৫, সবগুলো হাদিসের সনদ সহিহ ও শক্তিশালী।) রাসূল সা. কেবল নিজেই ডাকতেন না। সাহাবায়ে কেরামও ডাকাডাকি করতেন। বিষয়টি বুখারি ও মুসলিমের বর্ণনায় উঠে এসেছে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, রাসুল সা. বলেছেন, বিলালের আযান- অথবা বলেছেন- বিলালের ঘোষণা যেন তোমাদের কাউকে সেহেরি খাওয়া থেকে বিরত না রাখে। কেননা সে আযান দেয়- অথবা বলেছেন- সে ঘোষণা দেয়, যেন তোমাদের মধ্যে যে ইবাদতরত থাকে, সে ঘরে ফিরে যায় আর ঘুমন্তদের যেন জাগিয়ে তুলতে পারে। সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৬২১, সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ১০৯৩। সুতরাং সেহেরির জন্য ডাকাডাকি করা শরিয়তে স্বীকৃতি বিষয়। এজন্য সালাফের যুগেও এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। উতবাহ বিন ইসহাক যখন আব্বাসি খলিফা মুনতাসির বিল্লাহর পক্ষ থেকে মিশরের শাসক নিযুক্ত হন, তিনি ফুসতাতের আসকার শহর থেকে আমর ইবনে আস মসজিদ পর্যন্ত পায়ে হেঁটে সেহেরির জন্য মানুষকে ডাকাডাকি করতেন। ওদিকে মক্কায় ‘যামযামি’ এবং বাগদাদে ‘ইবনে নুকাত’ সেহেরির জন্যও ডাকাডাকি করতেন। যামযামি তো মসজিদের মিনারে উঠে সেহেরির জন্য ডাকতেন। এ সময় তার ছোট দুই ভাইও ডাকাডাকি করতেন। তাদের ডাকার ভাষ্য ছিল এমন, ‘হে ঘুমন্তরা, সেহেরির জন্য উঠুন।’ এ সময় তারা সাথে একটি রশিতে দু’টি বড় বাতি ঝুলিয়ে রাখতেন। যেন যারা কানে শুনে না, আলো দেখে সেহেরির সময় বুঝতে পারে। এভাবে পরবর্তী সময়ে সুরসহ ছন্দ ও গজল দিয়েও ডাকাডাকির প্রচলন শুরু হয়। এরপর সেহেরির জন্য আলাদা ঘোষকদলেরও ব্যবস্থা হয়। তাদের নেতৃত্বে বেশ কিছু লোক ড্রাম ও করতালে হালকা আওয়াজে গজলও গাইত। ইব্রাহিম আনানি- আল-আখবার নিউজ ১৫ রমজান ১৪১৪ হি.। তাই সেহেরির জন্য ডাকাডাকি করতে সমস্যা নেই। তবে যুগের পরিবর্তনে ডাকাডাকির উপায়েও ভিন্নতা এসেছে। এক্ষেত্রে উপায়গুলো যদি শরিয়াতের সাধারণ নীতি ও কাঠামোর মধ্যে থাকে, তবে সমস্যা নেই। সেজন্য সালাফের যুগে বাতি জ্বালিয়ে, ছন্দ ও কবিতা আবৃত্তি করে, গজল গেয়ে, যন্ত্র পেটানোসহ নানা উপায়ে ডাকাডাকির দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। এ ডাকাডাকির বিষয়কে কখনো ইবাদতের প্রতিবন্ধক মনে করা হয়নি। একইসাথে এভাবে ডাকাডাকি করে ঘুম থেকে জাগানোকেও ইতিবাচকভাবে দেখা হয়েছে। এক্ষেত্রে হাদিসের ভাষ্য লক্ষ্য করা যায়। রাসুল সা. বলেছেন, বিলালের আযান- অথবা বলেছেন- বিলালের ঘোষণা যেন তোমাদের কাউকে সেহেরি খাওয়া থেকে বিরত না রাখে। কেননা সে আযান দেয়- অথবা বলেছেন- সে ঘোষণা দেয়, যেন তোমাদের মধ্যে যে ইবাদতরত থাকে, সে ঘরে ফিরে যায় আর ঘুমন্তদের যেন জাগিয়ে তুলতে পারে। সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৬২১, সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ১০৯৩।) এখানে ঘুম থেকে জাগানো ও ইবাদতরতকে ঘরে ফেরানোকেই বিলাল রা.-এর ঘোষণার উদ্দেশ বলা হয়েছে।
তবে এ ডাকাডাকি অবশ্যই সহনীয় পর্যায়ে হতে হবে। সুতরাং ঘণ্টাখানেক আগ থেকে শেষ সময় পর্যন্ত খুব অল্প কথায় এবং অল্প সময়ে তিন থেকে চারবার ‘সাহরির সময়, কতক্ষণ বাকি আছে এবং শেষ সময়’ স্মরণ করিয়ে দিতে সমস্যা নেই। এতে বরং মানুষের উপকারই হবে। ডাকাডাকিটা এক মিনিট করে সর্বোচ্চ চারবার করা যেতে পারে। কিন্তু শেষ রাতে মসজিদের মাইকে যদি লম্বা-চওড়া কথাবার্তা বা গজল-নাশিদ দেয়া হয়, যা মানুষের মাঝে অস্বস্তি ও বিঘ্নতা সৃষ্টি করে, রুগ্ন ও অসুস্থ ব্যক্তিদের কষ্ট দেয়, সেটা উচিৎ হবে না। ফাতাওয়ায়ে শামি, খন্ড : ৪, পৃষ্ঠা : ৪৪৫, আল-ফিকহুল ইসলামী, খন্ড : ৮, পৃষ্ঠা : ১৮৩, খায়রুল ফাতাওয়া, খন্ড : ২, পৃষ্ঠা : ৭৭০, আহকামুল মসজিদ, পৃষ্ঠা : ৮৫, কাওয়ায়িদুল ফিকহ, পৃষ্ঠা : ১২৫। অবশ্য ঘনবসতিপূর্ণ শহর এবং গ্রাম এলাকার মাঝে কিছু ফারাক করা যেতে পারে। গ্রামে সময় ও সহযোগিতার দরকারটা বেশি পড়ে। মাইকের আওয়াজ সেখানে সাধারণত অসহনীয় ঠেকে না।
মানুষের মাঝে সময়, পরিস্থিতি, উপযোগিতা ও অভ্যাসের বড় একটি পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ঘুম-জাগরণ, সচেতনতা-উদাসিনতার স্বাভাবিক প্রবণতাগুলো এখনো পুরোপুরি বদলে যায়নি। এখনো মানুষ বিস্মৃতি কিংবা বে-খেয়ালিতে ভালো কাজ ছেড়ে দেয়। দেখাদেখি অথবা আওয়াজ শুনে নেক কাজে জড়ায়। সমাজে এমন বহু মুসলিম আছেন, নেকির পথে চলতে গেলে তাদের আওয়াজের দরকার হয়, আবহাওয়ার দরকার হয়, পরিবেশের দরকার হয়, দেখাদেখির দরকার হয়, ডাকাডাকিরও দরকার হয়। তাদের জন্য আওয়াজের উপায়টা খোলা থাকা দরকার। এসব না হলে তারা গাফেলই থেকে যায়। আবহমানকাল থেকেই আমাদের সমাজে সেহেরি-ইফতারি ইমাম-মুয়াজ্জিনের আওয়াজ শুনে করা হয়। রমজানে ভোররাতে ডাকাডাকি করা কিংবা হামদ-নাত গাওয়া, এটা যুগ যুগ ধরে চলে আসা আমাদের ঐতিহ্য। গ্রামে এখনো অনেক মানুষ আছেন, মাইকে ডাকাডাকি না শুনলে তারা জাগতে পারে না। তখন তাদের রোজাও ছুটে যায়। মোবাইল ফোনে এলার্ম দিয়ে ঘুম থেকে উঠা কোনো সহজ ব্যাপার নয়। এক্ষেত্রেও মানবিক দুর্বলতাগুলো কাজ করে। তাছাড়া এর মাধ্যমে যাদের নেকির পথে চলার জন্য দেখাদেখি প্রয়োজন, তাদের প্রয়োজনও পুরা হয় না। সেজন্য মোবাইলের এলার্মের প্রসঙ্গ টেনে ডাকাডাকির প্রতি অনুৎসাহিত না করা চাই। মোটকথা, সেহেরির জন্য ডাকাডাকি অবশ্যই বজায় থাকুক। তবে সেটা সহনীয় পর্যায়ে হোক। লেখক : সিনিয়র মুফতি, মসজিদুল আকবর কমপ্লেক্স মিরপুর ঢাকা।
Leave a Reply