আবু সাঈদ সাতক্ষীরা: যাদের জীবনের বিনিময়ে আমরা যারা আজ বংশপরম্পরায় স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছি, তারা এক কাতারে দাঁড়িয়ে সেই জীবন উৎসর্গ করা আমাদেরই স্বজন জাতীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাগণকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ৯নং সেক্টরের মুক্তিযুদ্ধের ভুমিকা ও গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সুন্দরবন সীমান্ত অঞ্চলের বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের দক্ষতাপূর্ণ গেরিলা এবং সন্মুখ যুদ্ধের ফলে এই অঞ্চলই প্রথম শত্রুমুক্ত হয়। গেরিলা যোদ্ধাদের পরিকল্পিত হামলার ফলে ১৯৭১ এর ১৯ নভেম্বর সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলা থেকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শ্যামনগর অঞ্চল থেকে প্রথমে হটে যেতে বাধ্য হয়। এখানে ৪/৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। ১৯ নভেম্বর ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রথম পাক হানাদার মুক্ত হয় দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তবর্তী সুন্দরবন উপকূল ও শ্যামনগর অঞ্চল।
২০ নভেম্বর বসন্তপুর, নাজিমগজ্ঞ কালিগঞ্জে ক্যাপ: নুরু পাকবাহিনীর সাথে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে টিকতে না পেরে কালিগজ্ঞ অঞ্চল থেকে পাকিস্তান আর্মি পিছু হটে দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া অভিমুখে চলে যায় কালীগজ্ঞের যুদ্ধে পাকবাহিনী বহুগোলা-বারুদ ও সৈন্য হারিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়।বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ পুরা অঞ্চল দখলে নেয়। ২০ নভেম্বর ৯নং সেক্টরের অন্যতম যুদ্ধপরিচালনাকারী ক্যাপ: নুরুল হুদা সহগ্রাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাবেশের মাধ্যমে কালিগঞ্জে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল এর নির্দ্দেশে যোদ্ধাগণ পায়ে হেঁটে অগ্রবর্তী পাক ঘাঁটিতে আক্রমন চালানোর জন্য অগ্রসর হয়।এদিকে ক্যাপ: মাষ্টার শাহজাহান তাঁর বাহিনী নিয়ে মাঝ পথে আক্রমন চালায়। পাক-হানাদাররা দিশাহারা হয়ে পারুলিয়া ব্রিজ ধ্বংস করে দিয়ে কুলিয়া ব্রিজের উত্তর পারে অবস্থান গ্রহণ করে। ক্যাপ: নুরুল হুদা তাঁর বাহিনী নিয়ে ৪ মাইল দূরে অবস্থান নেয়। লেপ্ট্যানেন্ট মাহফুজ আলম বেগ জানান, তিনি ‘রাতের অন্ধকারে কয়েকজন গেরিলা যোদ্ধা নিয়ে পাকসেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডিনামাইট দ্বারা কুলিয়া-শ্রীরামপুর ব্রিজ উড়িয়ে দেন, এখানে কয়েকজন পাক-টহল সেনা নিহত হয়। ‘এখানে ত্রিমুখী যুদ্ধে হানাদার সৈন্য, গোলাবারুদ হারিয়ে টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
নবম সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাগণের নিরাপদ ঘাটি ছিল ভারতের হিঙ্গলগঞ্জ, হাসনাবাদ, টাকী, সমশেরনগর। সেখান থেকে দলে দলে মাতৃভুমিতে ঢুকে ক্ষুধার্ত বাঘের ন্যায় পাকআর্মি ও তাদের দোসর রাজাকার আলবদরদের উপর হামলা চালায়। এদিকে ভোমরা সীমান্তে ভীষণ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে হানাদার বাহিনী সাতক্ষীরা অভিমুখে পালিয়ে যায়।মেজর এম,এ জলিলের ‘সীমাহীন সমর’থেকে জানা গেছে, ক্যাপ: হুদা, মি: চৌধুরী, ও শাহজাহনের নেতৃত্বাধিন মুক্তিবাহিনী ও তার লোকজর একত্র করে আটটি কোম্পানিতে বিভক্ত করেন যুদ্ধ পরিচালিত হয়। লে: মোহাম্মদ আলী, লে: আহসানউল্লাহ, লে: শচীন এবং চৌধুরীকে নেতৃত্বের দায়িত্ব দিয়ে ব্রিজের দিকে (কুলিয়া) অগ্রসর হয়ে যুদ্ধের নির্দেশ প্রদান করা হয়। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘২৩ নভেম্বর চার মাইল দুরে আর একটা ব্রিজের পিছনে হানাদাররা সরে গেল। ‘অর্থাৎ পাকআর্মিরা আলীপুর ব্রিজের সাতক্ষীরা পারে অবস্থান নেয়। ২৩ নভেম্বর সীমান্তবর্তী দেবহাটা, কুলিয়া, ভোমরা অঞ্চল পাক-হানাদার মুক্ত হয়। এরপর তারা আলীপুর ব্রিজ ভেঙে দিয়ে সাতক্ষীরার পারে ঘাঁটি গাড়ে। মুক্ত হয় সাতক্ষীরর সীমান্ত অঞ্চল।
দীর্ঘ পরাধীনতার পর এ অঞ্চলের মানুষ প্রথম গ্রহণ করে মুক্ত বাতাস। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফোর্স হেডকোয়ার্টারের ২৩ নভেম্বর ১৯৭১ এ
স্বাধীনতার এই ঊষালগ্নের কথা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান অধিনায়ক কর্ণেল এমএ জি ওসমানী প্রথমে সাতক্ষীরার হানাদার মুক্ত স্বাধীন অঞ্চল পরিদর্শন করেন ২৬ নভেম্বর’ ১৯৭১ খ্রি:। তাঁর এই পরিদর্শনে বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ উৎসাহীত হন এবং জীবনপন যুদ্ধ শুরু হয়। এ সময় তাঁর একান্ত সচিব, বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামাল ও অন্যান্য সমর নায়কগণ উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের নবম সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল, ক্যাপ: নুরুল হুদাসহ অন্যান্য সামরিক কর্তাগণ তাকে অভ্যর্থনা জানান।
এ পর্যায়ে স্বাধীন ও মুক্তাঞ্চল দেবহাটায় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা হয়। এই ক্যাম্প প্রথম পরিদর্শনে আসেন তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী (জাতীয় নেতা) এম কামরুজ্জামান। এসময় তাঁর সাথে ছিলেন দেশী-বিদেশী গণমাধ্যম কর্মী ও রাজনৈতিক নেত্রীবৃন্দ। দলে দলে মুক্ত উৎসুক জনতা তাঁদের অর্ভথ্যনা জানায়। মুক্তিযুদ্ধের এই ঐতিহাসিক স্থান এবং নিরূপিত হওয়া উচিত।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে নি:সন্দেহে বলা যায় ১৯৭১ এর নভেম্বর মাসের মধ্যে নবম সেক্টরের এই অসাধারণ ভুমিকায় বীর মুক্তিযোদ্ধাগণকে যুদ্ধজয়ে আত্ম প্রত্যয়ী করেছিল, এবং ভুক্তভোগী দেশী-বিদেশী স্বাধীনতাকামী কোটি কোটি জনতাকে বাংলাদেশ স্বাধীনের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়ন করেছিল। এ পর্যায়ে সারাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ জয়ের আকাক্সক্ষা বেড়ে যায়। দলে দলে আনাড়ি পথে সাতক্ষীরা শহরে মুক্তিযোদ্ধাগণ ঢুকে পড়ে। ক্রমাগত কখনো গেরিলা,কখনো সন্মুখ আক্রমনের মুখে পাকিস্তানি আর্মিরা সাতক্ষীরা থেকে ছাউনি গোঠাতে বাধ্য হয়। সাতক্ষীরা যুদ্ধে কয়েক জন পাকআর্মি,অফিসার নিহত ও গাড়ি ধ্বংস হয়। এই অবস্থায় অস্ত্র-সস্ত্র, গোলাবারুদ ফেলে তারা পশ্চাৎপদ অনুস্মরণ করে। মেজর এমএ জলিল উল্লেখ করেছেন, ডিসেম্বর মাসের তিন তারিখের মধ্যে পাকসেনারা সাতক্ষীরা শহর ছেড়ে চুকনগর-দৌলতপুর রাস্তা ধরে খুলনার পথে রওনা হয়। হানাদার মুক্ত হয় সাতক্ষীরা।
Leave a Reply