আজকের সাতক্ষীরা দর্পণ ডেস্ক: ক্ষতির কথা শুনে কি করবা, সব তো শেষ। ছেলে পিলে নে কি খেয়ে বাঁচবো জানিনে, রেমাল আমাগে পথে বসিয়ে দেছে’। কথাগুলো বলতেই কন্ঠ ভারী হয়ে উঠে চল্লিশোর্ধ্ব বয়সী গাবুরার চাঁদনীমুখা গ্রামের বিলাল খাঁর। নিজেকে সামলে নিয়ে দুই সন্তানের জনক ঘের ব্যবসায়ী বিলাল আরও জানান ‘একদিন আগেও বিশ হাজার টাকার মাছ ছাড়িছি, আজ দুপুরের সময় ঘের ছেড়ে উঠে আইছি’। বসতভিটা ছাড়া নিজের কোন জায়গা-জমি নেই। তিন বছর আগেও গ্রামবাসীর জমিতে কৃষি শ্রমিকের কাজের পাশাপাশি বন-বাদা করে সংসার চালাতেন তিনি। পরবর্তীতে পারিবারিক স্বচ্ছলতার কথা ভেবে অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চিংড়ি চাষ শুরু করেছিলেন। তবে দুই বছরের মাথায় এসে আবারও তিনি পথে বসেছেন। তবে এবার তার সাথে যোগ হয়েছে ঋণের বোঝা। বিলালের দাবি রিমালের প্রভাবে টানা বৃষ্টিতে আরও অনেকের মত তার ১০ বিঘা জমির চিংড়িঘের সম্পুর্ন ভেসে গেছে। প্রতি বিঘা ১১হাজার টাকা হারী (ইজারা) পরিশোধের পাশাপাশি মাছ ছাড়াসহ অন্যান্য খরচ বাবদ ইতিমধ্যে আরও এক লাখ ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছেন। নওয়াবেঁকী গনমুখী ফাউন্ডেশন থেকে ৭০ হাজারের পাশাপাশি বাকি দেড় লাখ টাকা স্থানীয় মাহজনের নিকট থেকে নেয়া ঋণ। সম্পূর্ণ ঘের ভেসে যাওয়ায় তিনি এখন পথে বসে গেছেন বলেও দাবি করেন।
প্রায় অভিন্ন অসহায়ত্বের কথা বর্ণনা করেন নাপিতখালী গ্রামের সাকিজ গাজী। পেশায় ট্রলার (ইঞ্জিন চালিত নৌকা) চালক এ বৃদ্ধ জানান, একমাত্র ছেলের সাথে মিলে পালা করে নদীতে যাত্রী পারাপারের কাজ করেন তিনি। দু’জনের উপার্জন দিয়ে তাদের সাত সদস্যের পরিবারের খরচ চালানো হয়। তবে রবিবার রাতে নদীর চরে বেঁধে রাখা ট্রলার কপোতাক্ষ নদীতে ডুবে যাওয়ায় তিনি এখন নিঃস্ব। আয় রোজগারের পথ বন্ধ হওয়ায় সামনের দিন দুরের কথা, আজকের দিনটার চাল ডাল তেল পানি কেনা নিয়েই তারা দুশ্চিন্তায়। তবে শুধু বিলাল বা সাকিম গাজী না। বরং ঘুর্ণিঝড় রিমাল নাপিতখালীর আজিজুল হক, হরিশাখালীর হুদা মালী, কেনারাম মন্ডলসহ আরও অনেককে পথে বসিয়ে দিয়েছে। আয় রোজগারের একমাত্র সম্বলসহ চড়াসুদে নেয়া ঋণের টাকায় নির্মিত বসতবাড়িসহ চিংড়ি ঘের ভেসে যাওয়ায় এখন তারা একেবারে নিঃস্ব। স্থানীয় সমিতিসহ মহাজনের থেকে নেয়া ঋণের বোঝা মাথায় করে এলাকায় বসবাস নিয়েও তারা শংকিত বলে জানান।
সুন্দরবন সংলগ্ন সিংহড়তলী গ্রামের অরবিন্দ মন্ডল দৈনিক আজকের সাতক্ষীরা দর্পণকে জানান সমিতি থেকে নেয়া ঋণের টাকায় চার মাস আগে চার চালা ঘর বেঁধেছিলেন। কিন্তু সোমবার দুপুরে ঝড়ের আঘাতে তার চাল উড়ে পাশের নদীতে পড়েছে। ঘর মাটির সাথে মিশে যাওয়ায় পরিবার নিয়ে বনশ্রী বিদ্যালয়ের সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছেন। জীবদ্দশায় তার পক্ষে আবার একটা ঘর তৈরী সম্ভব হবে না জানিয়ে অঝোরে চোখের পানি ফেলতে থাকেন তিন সন্তানের পিতা অরবিন্দ।
এদিকে নাপিতখালীর জহুরা বেগম জানায় আগের রাতে সাইক্লোন শেল্টারে যাওয়ার পথে স্বামীশওকাত আলীকে হারিয়েছেন। ছেলেরা কাজের জন্য এলাকার বাইরে থাকায় ছয় বছর বয়সী নাতির সাথে তারা সাইক্লোন শেল্টারে যাচ্ছিলেন। নদীর চরের সরকারি জমিতে বসবাস করে স্বামীর করা ছাগলের খামারের উপর নির্ভর করে চলতো তিনজনের সংসার। স্বামী হারানোর পাশাপাশি জোয়ারের তোড়ে চরে থাকা বসনত ঘর ভেসে যাওয়ায় নাপিতখালী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাইক্লোন শেল্টার-ই তার আশ্রয় স্থলে পরিনত হয়েছে। জহুরার মতো স্বামীকে না হারালেও রিমাল এর আঘাতে বসতবাড়িসহ আয় রোজগারের উৎস চিংড়িঘের হারানোর কথা জানিয়েছে আরও অনেকে। তাদের দাবি আইলার আঘাতের ১২ বছরেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি পরিবারগুলো। বাঁধ না ভাঙলেও টানা বৃষ্টির সাথে ছাপিয়ে আসা জোয়ারের পানি তাদের সর্বশান্ত করে দিয়েছে।
গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম দৈনিক আজকের সাতক্ষীরা দর্পণকে জানান, প্রশাসনের হস্তক্ষেপে সময়মত মানুষ সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নেয়ায় জীবনের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো গেছে। তবে ঝড়ের সাথে তীব্র জোয়ারের পানি ও ঢেউয়ের আঘাতের পাশাপাশি টানা বৃষ্টিতে শুধু গাবুরায় প্রায় এক হাজার বিঘা জমির চিংড়িঘের পানিতে ভেসে গেছে। স্বামীকে হারানো বৃদ্ধা জহুরা বেগমের সাহায্যের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে অনুরোধ করা হবে।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজিবুল আলম জানান রবিবার একজনের মৃত্যু ছাড়া তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। তবে সোমবার ঝড়ের সাথে টানা বৃষ্টিতে অসংখ্য চিংড়িঘের ভেসে যাওয়ার পাশাপাশি বসতঘরের ক্ষয়ক্ষতি হলেও সংখ্যা ও ক্ষতির পরিমান নির্ধারণে সময় লাগবে।
Leave a Reply