কাজী মারুফ হোসেন: ইসলাম মানবতার কল্যাণ ও পারস্পরিক সহানুভূতির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। রমজানের রোজা শুধু আত্মসংযমের মাধ্যমই নয়, বরং এটি দানশীলতা, সহমর্মিতা ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের অন্যতম উপায়। ইফতার করানো এমন একটি মহৎ আমল, যা একদিকে মানুষকে আল্লাহর সন্তুষ্টির দিকে ধাবিত করে, অন্যদিকে সমাজে ভালোবাসা ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে। কুরআন ও হাদিসে ইফতার করানোর বিশেষ ফজিলত বর্ণিত হয়েছে, যা এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, সে রোজাদারের মতোই সওয়াব লাভ করবে, তবে রোজাদারের সওয়াব মোটেও কমবে না।” (তিরমিজি, হাদিস: ৮০৭)। রমজানে রোজাদারদের ইফতার করানোর মাধ্যমে যে পরিমাণ সওয়াব পাওয়া যায়, তা অন্য অনেক ইবাদতের তুলনায় ব্যতিক্রমী ও বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ।
পবিত্র কুরআনে দানশীলতার ওপর অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ইফতার করানোও এই দানশীলতার অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তাআলা বলেন: “আর তারা আল্লাহর মহব্বতে অভাবগ্রস্ত, ইয়াতিম ও বন্দীদেরকে খাদ্য খাওয়ায়। তারা বলে, ‘আমরা তোমাদেরকে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য খাওয়াচ্ছি, আমরা তোমাদের কাছ থেকে কোনো প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা চাই না।” (সূরা আদ-দাহর: ৮-৯)।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইফতার করানোর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন: “যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তা তার গুনাহ মোচন ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির কারণ হবে। সে রোজাদারের সওয়াবের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে, অথচ রোজাদারের সওয়াবে কোনো ঘাটতি হবে না।” (সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস: ১৭৪৬)।
ইফতার করানো শুধু দুনিয়াবি কল্যাণ বয়ে আনে না, বরং আখিরাতের মুক্তির পথও সুগম করে। এ কারণে মুসলিম সমাজে ইফতার করানোকে অত্যন্ত মহিমান্বিত আমল হিসেবে গণ্য করা হয়।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন দানশীলতার সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। রমজান মাসে তাঁর দানশীলতা আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পেত। হাদিসে এসেছে: “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন সবচেয়ে বেশি দানশীল ব্যক্তি। আর রমজানে যখন জিবরাইল (আলাইহিস সালাম) তাঁর কাছে আসতেন, তখন তাঁর দানশীলতা আরও বেড়ে যেত। এই সময়ে তিনি প্রবাহমান বাতাসের চেয়েও অধিক দানশীলতা করতেন।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৯০২)
তিনি নিজে মানুষকে ইফতার করাতেন এবং সাহাবাদেরও এ কাজে উৎসাহিত করতেন। রমজানে দানশীলতা ও ইফতার করানোর মাধ্যমে মানুষ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাহকে বাস্তবায়ন করতে পারে। ইসলাম ইফতার করানোর ক্ষেত্রে ব্যয়বহুল আয়োজনকে নিরুৎসাহিত করেছে। সামান্য কিছু দিয়েও ইফতার করানো সম্ভব। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে এক খেজুর, এক ঢোক পানি বা এক চুমুক দুধ দিয়ে ইফতার করাবে, সে-ও একই সওয়াবের অধিকারী হবে।” (সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস: ১৭৪৬)।
এ থেকে বোঝা যায়, ইফতার করানোর জন্য বড় পরিসরের আয়োজন বা ব্যয়বহুল খাবারের প্রয়োজন নেই। সামান্য কিছু দিয়েও আল্লাহর অসীম রহমত ও সওয়াব লাভ করা সম্ভব।
ইফতার করানোর মাধ্যমে সমাজে পারস্পরিক ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্ববোধ বৃদ্ধি পায়। এটি ধনী-গরিবের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যম এবং মুসলিম সমাজকে আরও ঐক্যবদ্ধ করার সুযোগ সৃষ্টি করে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “তোমরা ক্ষুধার্তকে আহার দাও, রোগীকে সেবা কর এবং বন্দীকে মুক্ত কর।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৬৪৯)।
এই হাদিসের নির্দেশনা অনুসারে, ইফতার করানোর মাধ্যমে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয় এবং দুস্থদের প্রতি সহানুভূতির মনোভাব গড়ে ওঠে। ইফতার করানোর ফজিলত শুধু দুনিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আখিরাতেও এর সুফল পাওয়া যাবে। কুরআনে বলা হয়েছে: “তিনি (আল্লাহ) তাকে এমন একদিনের বিপদের কারণে খাদ্য দান করতে বলেছেন, যে দিন হবে ভয়ংকর।” (সূরা আল-ইনসান: ৮)।
এই আয়াতে বোঝানো হয়েছে, ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করা কিয়ামতের দিন আল্লাহর রহমত পাওয়ার অন্যতম উপায়। রমজান কেবল আত্মসংযমের মাস নয়, এটি দানশীলতা, সহানুভূতি ও মানবিকতার চর্চারও সময়। ইফতার করানোর মাধ্যমে মানুষ কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টিই অর্জন করে না, বরং এটি দুনিয়াতে সম্প্রীতি ও পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করে। ইফতার করানোর অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে একজন মুমিন তার ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে।
লেখক: জেলা সাংবাদিক এসোসিয়েশন সাতক্ষীরা এর যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক কাজী মারুফ হোসেন।
Leave a Reply