নিজস্ব প্রতিনিধি: সাতক্ষীরা শহরের বুক চিরে বয়ে প্রাণসায়ের খাল পুনঃখননে কোনো কাজে আসেনি বরং নানা ধরনের অনিয়মের কারনে সরকারেরর কোটি কোটি টাকা নষ্ট হলো। প্রকল্পের এ পর্যন্ত ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হওয়ার পর গত ২০২১ সাল থেকে খনন কাজ বন্ধ হয়ে আছে। অন্যদিকে খননকৃত প্রাণসায়ের খালটি আবারও পূর্বের রূপে ফিরে গেছে। প্রাণসায়ের খালে এখন শহরবাসীর নিক্ষিপ্ত বর্জ আর কচুরিপানায় ভরাট হয়ে গেছে। পাশাপাশি বদ্ধ পানি আর নিক্ষিপ্ত বর্জে শহরের পরিবেশকে মারাত্মকভাবে দুষণ করছে। সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আবুল কালাম আজাদ জানান, সরকার ১০ কোটি ব্যয়ে সাতক্ষীরা প্রাণসায়ের খালটি পুন:খনন শুরু করে গত ২০২০ সালের দিকে। কিন্তু শুরু থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান একেবারে দায়সারাগোছের কাজ করে। সেই সময় সাতক্ষীরা নাগরিকদের পক্ষ থেকে মানববন্ধন এবং মিছিল সমাবেশও করা হয়। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হয়নি। কোনো রকম নেল কাদা তুলে ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ কাজ সম্পন্নের দাবী করার পর ২০২১ সালের দিকে অজ্ঞাত কারণে প্রাণসায়ের খনন কাজ বন্ধ রাখে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। তার পর থেকে অদ্যাবধি আর খনন হলো না প্রাণসায়ের খালটি। শুধু সরকারের অন্তত ৯ থেকে ১০ কোটি টাকা নষ্ট হলো। প্রাণসায়ের খননে কোনো কাজে আসলো না। অন্যদিকে প্রাণসায়ের খালে জমে থাকা বদ্ধ পানিতে শহরবাসি ও সুলতানপুর বড় বাজারের নিক্ষিপ্ত বর্জে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। সাধারণ মানুষজন প্রাণসায়ের খালের পাশের রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে হলে মুখে রোমাল দিতে হয়। প্রচন্ড দুর্গন্ধে চলাচল মুশকিল হয়ে পড়েছে। তিনি আরো বলেন, ১৯৭৭ সালে, ১৯৯০-৯১ সালে, ২০০৭-০৮ সালেও প্রাণ সায়র খাল খনন করা হয়। কিন্তু ১৯৯০-৯১ সালে খালের দু’মুখে স্লুইস গেট নির্মাণ করে পানি চলাচলের স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ রেখে এই খনন নাটক জনগনের কোন কাজে আসেনি। এভাবে খনন কোন কাজে না আসার বিষয়টি বিভিন্ন সময়ে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং সাতক্ষীরার বিভিন্ন পর্যায়ের র্দুর্নীতিবাজদের সহায়তায় বর্ষার পূর্বে ৫/১০ ভাগ কাজ করে কাজ বন্ধ করে দেয়। তারপর সুযোগ বুঝে গোপনে বিল তুলে নেয়। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধিকাংশ কাজেই এই একই স্টাইলে দুর্নীতি জায়েজ করা হয়। তিনি আরো বলেন, নাগরিক সমাজের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তৎকালীন জেলা প্রশাসক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন খালের স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনার। একটি তদারকি কমিটি করে সেখানে নাগরিক কমিটির প্রতিনিধি রাখা হয়েছিল। কিন্তু আমরা যখনই খাল সঠিকভাবে খনন হচ্ছে না বলে অভিযোগ নিয়ে গেছি তখনই বলা হয়েছে কাজ শেষ হওয়ার আগে সঠিক না বেঠিক বুঝলেন কিভাবে? এভাবেই বিষয়টি ২-৩ বছর ঝুলিয়ে রেখে এখন বলা হচ্ছে ৫০-৬০ ভাগ কাজ হয়ে গেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নেল কাদা তোলা ছাড়া আর কোন কাজই করেনি ঠিকাদার। তিনি প্রাণ সায়র খাল সমস্যা সমাধানে খালের স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে সকল বাধা অপসারণের উদ্যোগ নেওয়ার দাবী জানান।
সাতক্ষীরা শহরের সুলতানপুরের বাসিন্দা আব্দুর রব জানান, প্রতিদিন ভোরে শহরে বসবারত কয়েকশ’ মানুষ খাল পাড়ের রাস্তা দিয়ে হাঁটাচলা করেন। খালের পানি পানির প্রবাহ না থাকায় বদ্ধ পানি পঁচে কালো হয়ে দুর্গন্ধ চড়াচ্ছে। অধিকাংশ সময় পথচারাীদের মুখে কাপড় দিয়ে হাটাচলা করতে হয়। খালের বদ্ধ পঁচা পানি বর্তমানে মশার নিরাপদ প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। যা শহরবাসির জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি দ্রুত খালে জমে শেওলা অপসারণ করে ও সুলতানপুর বড়বাজারের ব্যবসায়ীসহ খাল পাড়ে বসবাসকারীদের ময়লা আবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় থেকে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরকার ৬৪টি জেলার অভ্যন্তরীণ ছোট নদী, খাল ও জলাশয় পুন:খনন প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। এ প্রকল্পের প্রথম পর্যায় সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১-এর অধীনে ৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে জেলা শহরের প্রাণসায়ের খালের আট কিলোমিটার পুন:খননের জন্য ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই গোপালগঞ্জ জেলার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাসুদ অ্যান্ড টেকনিককে (জেডি) কার্যাদেশ দেয়া হয়। কাজের মেয়াদ দেয়া হয় ২০২০ সালের ১৬ জুন পর্যন্ত।
এ ব্যাপারে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাসুদ অ্যান্ড টেকনিকের স্বত্বাধিকারী জেডএ মাহমুদ ডন এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, সাতক্ষীরার প্রানসায়ের খালটি পুন:খননের শুরুতে নানা ধরনের বাধা বিপত্তির কারণে সময়ক্ষেপন হয়েছিলো। বিশেষ করে খালটির দু’পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না হওয়ায় মাটি রাখা বা অপসারণ করা খুব মুশকিল হয়ে পড়ে। তারপরও প্রায় ৭০ শতাংশ খনন কাজ শেষ করা হয়। কিন্তু বরাদ্দের টাকা ঠিকমত না পাওয়ায় কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৬০ শতাংশ কাজের অনুকুলে টাকা পরিশোধ করে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড ডিভিশন-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ সালাউদ্দিন বলেন, প্রাণসায়ের খালটি পরিপুর্ণ ভাবে পুন:খনন করতে হলে খালটির দু’পাড়ের অবৈধ স্থাপনা সম্পূর্ণভাবে অপসারণ বা উচ্ছেদ করতে হবে। তা না হলে প্রাণসায়ের পুন:খননে কোনো কাজে আসবেনা। তবে প্রাণসায়ের খাল পুন:খননে অনিয়ম হয়নি। এ পর্যন্ত প্রকল্পের ৬০ শতাংশ পুন:খনন কাজ শেষ দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। প্রকল্পটির এ পর্যন্ত ৩ কিলোমিটারের মতো খাল খনন হয়নি। ইতোমধ্যে প্রকল্পটি ক্লোজ করে ফেলা হয়েছে। তবে এব্যাপারে সাতক্ষীরা পৌর কর্তৃপক্ষ প্রাণসায়ের খাল কেন্দ্র করে একটি প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে শুনেছি।
Leave a Reply