দেবহাটা প্রতিনিধি: সাপ্তাহিক আট আনা হারে সঞ্চয় নিয়ে শুরু হওয়া প্রতিষ্ঠানটি ৪বার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। জেলার একমাত্র প্রতিষ্ঠান দেবহাটা উপজেলার কুলিয়া পূর্বপাড়া সমবায় সেচ ও কৃষি খামার সমিতি লিমিটেড কৃষিভিত্তিক সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় অবদান রাখায় ৪র্থ বারের ন্যায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছে।
জানা গেছে, দেবহাটা উপজেলার কুলিয়া ইউনিয়নে ৮০ দশকে মহাজনী দৌরাত্ন্য থেকে বাঁচতে ২২জন সদস্য নিয়ে শুরু করে সমিতিটি। ১৯ ডিসেম্বর ১৯৮০ সালে সমবায় নিবন্ধনের আওতায় আসে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে যার সদস্য দাঁড়িয়েছে ১০৪৭ জনে। কর্মকর্তারাই সরাসরি সদস্যদের নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করায় সমিতিটি বর্তমানে অর্থিক সচ্ছল। শুরু থেকে এ পর্যন্ত কোন অর্থ বছরে ঘাটতি ছিল না প্রতিষ্ঠানটির। সমিতির রয়েছে নিজস্ব ২ তলা বিশিষ্ট একটি ভবন। নিজস্ব পুকুরে মাছ চাষ, পোল্ট্রির খামার, হ্যাচারী সহ সেবা ও ঋণদান কর্মসূচি চালু রয়েছে। এ পর্যন্ত তারা ২৯৫ টি হাঁস-মুরগি পালন, ৩৪৫ টি মাছচাষ, ১৫০ টি পরিবারকে গবাদিপশু পালন, ৭৫ জনকে সেলাই মেশিন, আরো ৮৯ জনকে সাবলম্বী করতে বিভিন্ন খ্যাতে ঋণ প্রদান করেছে। সমিতির সার্বিক কার্যক্রম বিবেচনা করে কৃষিভিত্তিক/সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় অবদান রাখায় ৪র্থ বারের ন্যায় জাতীয় সমবায় পুরস্কার-২০২১ অর্জন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
সমিতির সফলতা স্থান নিয়েছে ভ্যান প্রকল্প। তৎকালিন সময় কুলিয়া সহ নিম্ন এলাকার মানুষের চলাচলের মাধ্যম ছিল ভ্যানগাড়ী। সে সময় কুলিয়ার খোরশেদ, আব্দুল জব্বার, পিয়াার আলী, লুৎফর রহমান মহাজনের কাছ থেকে দিন ১০ টাকা চুক্তিতে ভ্যান ভাড়া নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। দিনের পর দিন এভাবে তারা ভ্যান চালিয়ে মহাজনকে টাকা দিয়ে গেলেও কখনো ভ্যানের মালিক হতে পারেননি। তাই সমিতি থেকে তাদের নিয়ে ভ্যান প্রকল্প গ্রহন করা হয়। ৬ জনকে সরাসরি টাকা না দিয়ে ভ্যান কিনে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এরপর ৬ মাসের মাথায় ওই ৪ জন নিজেরাই ভ্যানের মালিক হয়ে যায়। এ দেখে সমিতির কর্তৃপক্ষের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। তারই ধারাবাহিকতায় সদস্যর দক্ষতা ও চাহিদা অনুযায়ী উপকরণ বা মালামাল প্রদান করা হয়। পাশাপাশি গ্রুপ ভিত্তিক বিভিন্ন চাষ ও উৎপাদনশীল প্রশিক্ষণের আয়োজন করে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর সরাসরি ব্যক্তিকে টাকার পরিবর্তে উপার্জনের উপকরণ সরবাহ করেন কর্তৃপক্ষ। তাদের এ সফলতার সম্মান জানাতে ১৯৮৪ ও ১৯৯২ সালে জাতীয় পর্যায়ে জেলা থেকে পুরস্কার এবং ১৯৯২ ও ২০২২ সালে জাতীয় পর্যায়ে ঢাকা থেকে জাতীয় পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে।
গত ৫ নভেম্বর এ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সমবায় দিবস ২০২২ উদযাপন এবং জাতীয় সমবায় পুরস্কার ২০২১ বিতরণে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি অংশ নেন। অনুষ্ঠানে মোট ৯টি সমবায় সমিতি এবং একজন ব্যক্তিকে জাতীয় সমবায় পুরস্কার-২০২১ প্রদান করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুুলে দেন। যার মধ্যে কুলিয়া পূর্বপাড়া সমবায় সেচ ও কৃষি খামার সমিতি লিমিটেড ছিল সব ক্যাটাগরীতে প্রথম স্থান অর্জন করে।
প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান নির্বাহী পরিচালক বাসুদেব মন্ডল জানান, মহাজনী ঋণ থেকে বাঁচাতে স্থানীয় চাষিদের নিয়ে ১৯৮৯ সালে কুলিয়া পূর্বপাড়া সমবায় সেচ ও কৃষি খামার সমিতি লিমিটেড গঠন করা হয়। শুরুতে সদস্যদের কাছ থেকে সপ্তাহে আটআনা করে জমা নেওয়া হত। যা মাসে জনপ্রতি ২ টাকা সঞ্চয়ে পরিণত হয়। এভাবে পুঁজি গঠন করে সদস্যদের মাঝে মৌসুমি ঋণ দেওয়া হত। যা দিয়ে ধান ও মাছ চাষ শুরু করে কৃষকরা। ধান ও মাছ বিক্রি করে এক কালিন বা সুবিধা অনুযায়ী সামান্য লাভ সহ ঋণের টাকা পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়। যা এখনো চালু আছে। এরই ধারাবাহিকতায় সপ্তাহে ৫ টাকা, ১০ টাকা করে সঞ্চয় করতে থাকে সদস্যরা। সদস্যদের এই টাকা একটি বড় শক্তিতে পরিণত হতে থাকে। নিজেদের পুঁজিতে চাষিদের কল্যাণে ধান চাষ, মাছের খামার, দুগ্ধ খামার, গরু মোটাতাজা, হাঁস-মুরগীর খামার, ভ্যান, ইজিবাইক প্রকল্প চলমান রয়েছে। সমিতির গ্রাহক ভরত কুমার রং জানান, আমি লোকের জায়গায় ঘর নির্মান করে বসবাস করতাম। আমার পক্ষে কখনো জমি ক্রয়ের সমার্থ ছিল না। পরে কুলিয়া পূর্বপাড়া সমবায় সেচ ও কৃষি খামার সমিতি লিমিটেড থেকে ঋণ নিয়ে ৭ বছর আগে ৮শতক জমি ক্রয় করি। পরে সেই টাকা পরিশোধ করে ঘর নির্মানের লোন নিয়ে নিজের একটি নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করতে পেরেছি। এই সমিতির মাধ্যমে আমার মত অসংখ্য মানুষের কল্যাণ হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানের বর্তমান সভাপতি জয়কৃষ্ণ সরকার জানান, প্রথম থেকে আমারদের উদ্দেশ্য ছিল সমবায় ভিত্তিতে কৃষিভিত্তিক সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন। সেই লক্ষে ৮% লাভে ঋণ প্রদান করা হয়। পাশাপাশি গরীব, অসহায়দের সহায়তা প্রদান। বার্ষিক বিভিন্ন কর্মসূচিতে সদস্যদের অংশ গ্রহন ও সমতার ভিত্তিতে মতামত গ্রহন করি। আগামীতে আমরা একটি সমবায় মার্কেট স্থাপন করতে উদ্যোগ গ্রহন করেছি। যেখানে আমাদের সমবায়ীদের উৎপদিত নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয়-বিক্রয় ব্যবস্থা করা হবে। তিনি আরো জানান, আমাদের প্রতিষ্ঠান সপ্তাহের কোন দিন বন্ধ থাকে না। সদস্যদের যেকোন সমস্যা নিয়ে আমাদের সাথে যোগাযোগ করলে তার সমাধানের ব্যবস্থা করা হয়। সদস্যরা দেশের যেকোন জায়গা থেকে আমাদের একাউন্টে টাকা পাঠালে বিনা খরচে তার বাড়ির সদস্যদের কাছে প্রদান করা যায়। পাশাপাশি কোন অভিজ্ঞ ডাক্তার দেখানোর দরকার হলে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের সাথে কম খরচে সংযোগ করে দেওয়া হয়। আমরা চাই সদস্যদের সার্বিক বিষয় এই সমবায় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে।
Leave a Reply