স্টাফ রিপোর্টার: দুই বছর আগে মূল ভবন পরিত্যক্ত হওয়ায় ইওসি (ইমারজেন্সি অবসট্রাকটিভ কেয়ার) বা জরুরী প্রসূতি সেবা ভবনের বারান্দাকে ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে শিশু ওয়ার্ড। প্রশাসনিক ভবনের দোতলায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত কক্ষটি বাদ রেখে অবশিষ্ট ছোট আয়তনের চার কেবিনকে পরিনত করা হয়েছে নারী ও পুরুষ রোগীদের জন্য সাধারণ ওয়ার্ডে। সব মিলিয়ে পাঁচ কেবিনে জোড়াতালি দিয়ে ১৭টি শয্যার ব্যবস্থা করা হলেও তার তুলনায় দুই-তিন গুন বেশি রোগীকে চিকিৎসা নিতে হয় ওই ভবনের ব্যালকনি আর মেঝেতে শুয়ে বসে।
একইভাবে জায়গার অভাবে দু’বছর যাবত অকার্যকর হয়ে পড়ে রয়েছে অতি প্রয়োজনীয় এক্স-রে মেশিন। ‘এ্যানেসথেশিয়া’ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সার্বক্ষণিক উপস্থিতির অভাবে অপারেশন কার্যক্রমও নিয়মিত নয় সেখানে। এছাড়া বেশকিছু দিন বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দকৃত আবাসিক ভবনে প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা ও যক্ষ্মা নির্ণয়ের কার্যক্রম পুনরায় চালু হলেও জায়গা সংকটে বন্ধ আলট্রাসনোগ্রাম। নার্সদের জন্য নির্ধারিত ডরমেটরির দুই কক্ষ নিয়ে জরুরী বিভাগের কার্যক্রম পরিচালিত হলেও কনফারেন্স, প্রশিক্ষণসহ টিকাদানের মত অন্যান্য জরুরী কাজগুলো চলছে অস্থায়ীভাবে নির্মিত টিনশেড ঘরে।
তবে শুধুমাত্র জায়গা আর অবকাঠামোগত অপ্রতুলতা নয়। বরং রীতিমত চিকিৎসক সংকটেও ধুকছে বিশাল জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত শ্যামনগর উপজেলার সর্ববৃহৎ সরকারি স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী এ প্রতিষ্ঠান। জনবল সংকটের দরুণ মাঝেমধ্যে যেমন একই চিকিৎসককে জরুরী ও বহির্বিভাগের দায়িত্ব একসাথে সামলাতে হচ্ছে। তেমনী বহির্বিভাগে তিন-চারশ’ রোগীকে অপেক্ষমান রেখে কোন কোন ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের ছুটতে হয় গুরুত্বপুর্ন অপারেশন ছাড়াও ওয়ার্ডে ভর্তিকৃতদের জরুরী চিকিৎসার কাজে।
অতি করুণ আর বাস্তব এ চিত্র সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা ৫০ শয্যা সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের। মূল ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণার পর দুই বছর অতিবাহিত হলেও নুতন অবকাঠামো নির্মিত না হওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসক সংকটের সমাধান না মেলায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে সেখানে। নামে ৫০ শয্যা হলেও কার্যত গড় পড়তায় প্রায় প্রতিদিন ৭০ থেকে ৯০ জনের মতো ভর্তি রোগীর চিকিৎসা চলে সেখানে। স্বল্প জায়গা আর সীমিত সুযোগ সুবিধার মধ্যে এত অধিক সংখ্যক রোগীর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে যেয়ে মারাত্মক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। কখনও আবার উপকরণ ও সরঞ্জামাদী থাকা সত্ত্বেও জায়গা সংকটের কারনে অসংখ্য রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে জেলা সদর কিংবা সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠাতে হচ্ছে। যদিও কর্তৃপক্ষের দাবি সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সেবা প্রত্যাশীদের চিকিৎসা নিশ্চিতে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার স্বল্পতা আর ব্যবহারযোগ্য সীমিত অবকাঠামোকে পুঁজি করে আগত রোগীদের চিকিৎসায় তারা নিরলসভাবে কাজ করছেন।
সরেজমিন ঘুরে ও চিকিৎসাধীন রোগীসহ তাদের স্বজন আর কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানা যায়, ৫০ শয্যার হাসপাতাল হলেও শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বর্তমান রোগী ধারণ ক্ষমতা অর্ধেকেরও কমে নেমে এসেছে। মূল ভবন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ার পাশাপাশি নুতন ভবন নির্মিত না হওয়ায় কার্যত ১৫-১৬ জনের বেশি রোগীকে ভর্তি রেখে চিকিৎসা সেবা দেয়া রীতিমত দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিদর্শনকালে দেখা যায় ওয়ার্ডে পরিণত করা প্রতিটি কেবিনে ৩-৪জনের জায়গা করা গেলেও অধিকাংশ রোগী করিডোর কিংবা সিঁড়ির দু’পাশসহ আশপাশের বারান্দায় শুয়ে বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন। স্বল্প আয়তনের ওয়ার্ড নামের কেবিনগুলো রোগীর চাপে রীতিমত থানার ‘গারদখানা’র রূপ নিয়েছে।
সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে চিকিৎসাধীন রোগীরা জানায়, নিতান্ত বাধ্য হয়ে তারা হাসপাতালে থাকছেন। রোগীর ভীড়ে সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে-দাবি করে তারা জানায় সার্বক্ষণিক চিকিৎসকের তদারকিতে থাকার জন্য চোখমুখ বন্ধ করে হাসপাতালে পড়ে রয়েছেন। ভুরুলিয়া গ্রামের জহির উদ্দীন জানান, রোগীর চাপে ছোট কক্ষগুলোতে পা ফেলার জায়গা মেলে না। বাধ্য হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে একদিন পার হতেই অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে তিনি বাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন। আটুলিয়া গ্রামের ষাটোর্ধ্ব বয়সী মনোয়ারা জানান তীব্র জ্বরের কারনে নাতিকে দু’দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। জায়গা না হওয়ায় কেবিনে প্রবেশদ্বারের সামনে বিছানা পেতে বেড তৈরী করে দিয়েছে নার্সরা। তবে জায়গা স্বল্পতা নিয়ে এমন অভিযোগ শুধুমাত্র মনোয়ারা আর জহির উদ্দীনের না। শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি রোগী ও স্বজনদের অভিযোগের বিষয় অভিন্ন। স্বল্প পরিসরে জায়গার মধ্যে চিকিৎসা নিতে এসে অধিকাংশ রোগী চিকিৎসা শেষ না করেই বেসরকারি ক্লিনিক কিংবা বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে বলেও দাবি তাদের।
কয়েকজন রোগী ও তাদের স্বজনরা অভিযোগ করেন জায়গা স্বল্পতার পাশাপাশি চিকিৎসক সংকটেরও শিকার তারা। জরুরী বিভাগে রোগীর চাপ বেশী থাকলে সময়মত যেমন চিকিৎসকের দেখা মেলে না, তেমনী ভর্তিকৃত জরুরী রোগীর সেবা দিতে যেয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বহির্বিভাগে অসংখ্য রোগীকে অপেক্ষা করতে হয় বলেও জানান তারা। ভুক্তোভোগী এসব রোগীসহ তাদের স্বজনরা বলেন শ্যামনগর উপজেলায় প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষের বসবাস। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার কারনে পাশর্^বর্তী কালিগঞ্জ, আশশুনি ও কয়রা উপজেলার অসংখ্য রোগী ভীড় জমায় শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এত গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এমন দুরাবস্থায় প্রায় চার লক্ষাধিক মানুষ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা থেকে দারুনভাবে বঞ্চিত। অবস্থার উত্তরণে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নুতন ভবন নির্মাণসহ চিকিৎসা সেবার মান বৃদ্ধির দাবি জানান তারা।
উপজেলা স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. জিয়াউর রহমান জানান, অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ইওসি ভবনের উপর নুতন দুটি ফ্লোর করে আপাত পরিস্থিতি সামাল দেয়ার পরিকল্পনা নয়া হয়েছে। গড়ে প্রতিদিন বহির্বিভাগে পাঁচ শতাধিক রোগীর সেবা দিতে যেয়ে চিকিৎসকরা হিমশিম খাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, আরও তিন চারজন মেডিকেল অফিসার হলে চিকিৎসকদের উপর চাপ কমতো।
Leave a Reply