তুহিন হোসেন: পদ্মা সেতু চালুর মাত্র এক বছরেই পাল্টে যাচ্ছে সাতক্ষীরার অর্থনীতি। সেতুর বদৌলতে সাতক্ষীরায় উৎপাদিত মাছ ও কৃষি পণ্য দ্রুত সময়ে পৌঁছে যাচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। ভোমরা স্থলবন্দরে পণ্য জট কমেছে। বেড়েছে আমদানি-রপ্তানি ও পাসপোর্ট যাত্রী পারাপার। অন্যদিকে শুরু হচ্ছে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ।
পদ্মা সেতুর কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হওয়ায় সুন্দরবনে বাড়ছে পর্যটক। নতুন করে এ খাতে বিনিয়োগ করছেন অনেকে। বন বিভাগের তথ্য মতে, পদ্মা সেতু চালুর পর সবশেষ ১০ বছরের মধ্যে এ বছর সর্বোচ্চ সংখ্যক পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করেছে। এতে রাজস্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি উপকূলের প্রান্তিক কর্মহীন মানুষদের কর্মসংস্থান বাড়ছে।
ভোমরা স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী ও আমদানিকারক মো. মোহসিন হোসেন দৈনিক আজকের সাতক্ষীরা দর্পণকে বলেন, ফেরি পারাপারের ভয়ে এক সময় ভোমরা বন্দর দিয়ে ঢাকার ব্যবসায়ীরা পণ্য আনতে চাইতেন না। ফেরিঘাটে জ্যামের কারণে অনেক সময় কোটি কোটি টাকার পণ্য পঁচে গেছে। দিনের পর দিন ট্রাকগুলো ঘাটে বসে থেকেছে। ফেরির কারণে কখনো সময়মতো পণ্য সরবারহ করা যেত না। সময়মতো ট্রাক পাওয়া যেত না। পরিবহন ব্যয় বেশি পড়তো। ঘাটের দালালদের অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে গাড়ি পার করতে হতো। সেতু চালু হওয়ার পর থেকে এই ঝামেলাগুলো নেই। টোল খরচ কিছুটা বেশি হলেও ভোমরা থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় দ্রুত সময়ে পণ্য পৌঁছে দেয়া যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা নতুন করে আবারো ভোমরা বন্দর বেছে নিচ্ছে। তিনি বলেন, সম্প্রতি ডলার সংকটের মধ্যেও এ বন্দরে প্রতিদিন তিন থেকে ৪শ’ ট্রাক পণ্য আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে। সবচেয়ে ভালো খবর বর্তমানে এখানে কোনো পণ্যজট নেই।
ভোমরা বন্দরের সি,এন্ড,এফ এজেন্ট এসোসিয়েশন এর সভাপতি আলহাজ্ব কাজী নওশাদ দিলওয়ার রাজু দৈনিক আজকের সাতক্ষীরা দর্পণকে বলেন আমাদের প্রচেষ্টায় পন্যবাহী ট্রাকের জন্য পার্কিং ব্যবস্থা করায় বন্দরে আমদানি রফতানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ভোমরা স্থল বন্দরে আমদানি রফতানি বেড়ে যাওয়ায় সরকারি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য মাত্রা পূর্বের তুলনায় অনেকাংশেই বেড়েছে। তবে এক্সপ্রেসওয়ে ও পদ্মা সেতু হয়ে পণ্য পরিবহনে সময় কম লাগার কারণে ঢাকার অনেক ব্যবসায়ীরা এ পথে পণ্য আমদানি করতে আগ্রহী হচ্ছেন।
ভোমরা বন্দরের সি,এন্ড,এফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এ এস এম মাকছুদ খান দৈনিক আজকের সাতক্ষীরা দর্পণকে বলেন, পদ্মা সেতু চালুর আগে থেকে ভোমরা বন্দর এলাকায় রাস্তার সংস্কার কাজ চলছিল সেটি কয়েক মাস আগে শেষ হয়েছে। এছাড়া ভারতীয় অংশে রাস্তা গুলো আগেই সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এজন্য এই বন্দরের যোগাযোগ ব্যবস্থা আগের চেয়ে এখন অনেক উন্নত হয়েছে।
এছাড়া কাস্টমসও বন্দর কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমে আগের চেয়ে গতি বেড়েছে। গেলো এক বছর ডলার সংকটসহ নানা কারণে এ বন্দর দিয়ে আমদানি কম হয়েছে। তবে এক্সপ্রেসওয়ে ও পদ্মা সেতু হয়ে পণ্য পরিবহনে সময় কম লাগার কারণে ঢাকার অনেক ব্যবসায়ীরা এ পথে পণ্য আমদানি করতে আগ্রহী হচ্ছেন।
তিনি বলেন, সম্প্রতি পেঁয়াজ আমদানি শুরু হলে প্রথম দিন সন্ধ্যায় এ বন্দরে ১১ ট্রাক পেঁয়াজ আসে। বন্দরে আসার পর সেই পেঁয়াজ খালাস শেষে ওই দিন রাতেই ঢাকা উদ্দেশ্যে বন্দর ছেড়ে গিয়ে পরদিন সকালে ঢাকার পাইকারি বাজার ধরে। বর্তমানে এখানে প্রতিদিন ১০০ থেকে দেড়শ ট্রাক পেঁয়াজ আসছে। এগুলো খালাসের পর ৬-৭ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় পৌঁছে যাচ্ছে। সময়মতো বাজার ধরতে পারায় ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছেন। এটি সম্ভব হয়েছে শুধু এক্সপ্রেসওয়ে ও পদ্মা সেতুর জন্য।
ভোমরা ইমিগ্রেশন পুলিশের অফিসার ইনচার্জ মাজরিহা হোসাইন দৈনিক আজকের সাতক্ষীরা দর্পণকে বলেন, আগে এ বন্দর দিয়ে শুধু সাতক্ষীরা জেলা ও আশপাশের পাসপোর্টধারী যাত্রীরা চলাচল করতো। তবে গত বছর পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশে অন্য জেলার যাত্রীরাও এ বন্দর হয়ে ভারতে যাতায়াত করছে।
তিনি আরোও বলেন, সাতক্ষীরা শহর থেকে ভোমরার দূরত্ব মাত্র ১৫ কিলোমিটার আর ভোমরা থেকে ভারতের কলকাতার দূরত্ব মাত্র ৭০ কিলোমিটার। বর্তমানে ঢাকা থেকে বাসযোগে সাতক্ষীরা আসতে সময় লাগে ৫-৬ ঘণ্টা। এছাড়া এই পথে ঝক্কি ঝামেলাও অনেক কম। মূলত এসব কারণে অনেকে এই বন্দরের ইমিগ্রেশনকে বেছে নিচ্ছেন।
এদিকে পদ্মা সেতু চালুর পর পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জে পর্যটকদের আসা যাওয়া বেড়েছে সুন্দরবনে। বন বিভাগ তথ্য অনুযায়ী গেলো ১০ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম রেকর্ড সংখ্যক পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণে এসেছেন। সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক ইকবাল হোছাইন চৌধুরী দৈনিক আজকের সাতক্ষীরা দর্পণকে বলেন, সুন্দরবনে বর্তমানে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা থাকায় পর্যটক প্রবেশ বন্ধ। গেলো মে মাস পর্যন্ত শুধু সাতক্ষীরা রেঞ্জে প্রায় দেড় লাখ পর্যটক এসেছেন। পদ্মা সেতুর কারণে এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার কারণে আগামীতে সুন্দরবনে পর্যটকের সংখ্যা আরও বাড়বে।
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক, ম্যানেজিং ডিরেক্টর, তুফান কোম্পানী, সাতক্ষীরা ও সভাপতি- সাতক্ষীরা জেলা পুলিশিং কমিটি ডা: আবুল কালাম বাবলা দৈনিক আজকের সাতক্ষীরা দর্পণকে বলেন, পদ্মা সেতু চালুর মধ্যে দিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা সাতক্ষীরার যোগাযোগ ব্যবস্থা বদলে গেছে। গত এক বছরে সাতক্ষীরার আর্থ সামাজিক অবস্থার অনেক উন্নতি ঘটেছে। জেলার মানুষরা দ্রুত সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করতে পারছেন। ভোমরা বন্দরে পরিবর্তন আসছে। অনেক ব্যবসায়ী সাতক্ষীরায় নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন। জেলায় উৎপাদিত মাছ ও কৃষি সামগ্রী দ্রুত সময়ে ঢাকার বাজার ধরতে পারছে। এতে মৎস্য খামারি ও চাষিরা লাভবান হচ্ছেন। মোট কথা পদ্মা সেতুর কারণে এ অঞ্চলের অর্থনিতির চিত্র বদলাতে শুরু করেছে। এছাড়া সুন্দরবনে পর্যটকদের আগমন বাড়ায় উপকূলীয় এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও প্রান্তিক মানুষের কর্মসংস্থান বাড়ছে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক হুমায়ুন কবির বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর থেকে সাতক্ষীরার সাথে দেশের অন্য জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়েছে। এ জেলায় রপ্তানি পণ্য চিংড়িসহ প্রচুর মাছ উৎপাদন হয়। এছাড়া এটি কৃষিসমৃদ্ধ জেলা। সাতক্ষীরার আমের সুনাম রয়েছে দেশজুড়ে। সব মিলিয়ে সাতক্ষীরায় একটি বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠতে পারে।
তিনি বলেন, এরই মধ্যে সরকার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অচিরেই সাতক্ষীরা অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ শুরু হবে। এখানে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
Leave a Reply