শংকর ঘোষ,ডুমুরিয়া(খুলনা): আগামীকাল ২০ মে।ঐতিহাসিক চুকনগর গণহত্যা দিবস।১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আজকের এই দিনে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী চুকনগরের বিভিন্ন স্থানে গুলি করে ১০/১২ হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।বিশ্বের গণহত্যার ইতিহাস গুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে এটাই বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণহত্যা।বিশ্বের আর কোথাও এতো অল্প সময়ে একসাথে এতো মানুষকে প্রাণ দিতে হয়নি।১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মে মাসের মাঝামাঝি সময় বৃহত্তর খুলনার বাগেরহাট,রামপাল,মোড়েলগঞ্জ,কচুয়া,শরণখোলা,মোংলা,দাকোপ,বটিয়াঘাটা,ডুমুরিয়া, চালনাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের কয়েক হাজার মানুষ ভারতে যাবার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।তারা খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর থেকে সাতক্ষীরা হয়ে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।এজন্যে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে ১৯ মে রাতের মধ্যে সবাই চুকনগরে এসে পৌঁছায়।খুলনা জেলা সদর থেকে ৩০ কি.মি.দুরে অবস্থিত চুকনগর।ওই দিন রাতে কয়েক হাজার মানুষ চুকনগরের পাতোখোলা বিল,কাঁচাবাজার,মাছবাজার,কাপুড়িয়া পট্টি,গরু হাট,কালী মন্দিরসহ বিভিন্নস্থানে অবস্থান করতে থাকে।রাতটা এখানে পার করে সকালে কিছু মুখে দিয়ে রওনা হবে ভারতের উদ্দেশ্যে। পর দিন ২০ মে খুব ভোরে কেউ কেউ চুকনগর ছেড়ে রওয়ানা হয়ে যায়।তবে অধিকাংশরা সকালের খাওয়া দাওয়া শেষে রওনা হবে।এজন্যে সকালে তারা রান্না বান্নার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।কারও রান্না ততক্ষনে শেষও হয়েছে।কেউ বা ভাতের থালা নিয়ে বসে পড়েছে।ঠিক এমনই মুহুর্তে সাতক্ষীরা থেকে পাক বাহিনীর ১টি ট্রাক ও ১টি জীপ চুকনগরÑসাতক্ষীরা সড়ক ধরে মালতিয়া মোড়ের ঝাউতলায় এসে হঠাৎ থেমে যায়।ওই সময় রাস্তার পাশে পাট ক্ষেতে কাজ করছিলেন মালতিয়া গ্রামের চিকন আলী মোড়ল নামে এক বৃদ্ধ।গাড়ীর শব্দে তিনি উঠে দাঁড়ালে পাক বাহিনী তাকে প্রথমে গুলি করে হত্যা করে।এরপর একই গ্রামের সুরেন্দ্র নাথ কুন্ডুকেও গুলি করে হত্যা করে।এরপর তারা বাজারের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করতে থাকে নিরীহ মানুষকে।নারী,শিশু,বৃদ্ধ কাউকে তারা রেহাই দেয়নি সেদিন।গুলির শব্দে আর এখানে জড়ো হওয়া নারীÑপুরুষের আর্তচিৎকারে আতংকিত হয়ে পড়ে আশ পাশের গ্রামের মানুষ।ভারী হয়ে ওঠে সমগ্র এলাকার পরিবেশ।চারিদিকে শুধু কান্নার শব্দ,হুড়োহুড়ি আর দৌঁড়াদৌড়ি।এরপর সবকিছুই একসময় নীরব হয়ে যায়।তখন চারিদিকে পড়ে আছে মানুষের লাশ আর তাজা রক্ত।চুকনগর সেদিন এক মৃতপুরীতে পরিণত হয়।পাকিস্থানীদের এই তান্ডবলীলা ২/৩ ঘণ্টা ধরে চলেছিল বলে জানা যায়।সেদিন মানুষের আর্তচিৎকার ও দৌঁড়া দৌঁড়িতে পায়ের তলায় পিষ্ট হয়েও মরেছে অনেক শিশু ও বৃদ্ধ।কত শিশুকে তার মা ফেলে পালিয়েছে।কিন্তু তারা কেউ বাঁচতে পারেনি।অনেক শিশু মৃত মায়ের বুকের উপর স্তন পান করছে।কিন্তু তার জন্মধাত্রী মা চলে গেছে না ফেরার দেশে।মাকে হারিয়ে কত শিশু অসহায়ের মত বসে কাঁদছে এমনই সব দৃশ্য সেদিন দেখেছিল এলাকার মানুষ।পাক সেনাদের তান্ডবে চুকনগরের ধুসর মাটি আর সবুজ ঘাস মুহুর্তের মধ্যে লাল হয়ে উঠেছিল।চুকনগর বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ভদ্রা নদীতে ছিল লাশের বহর।ভদ্রা নদীতে পানির সাথে একাকার হয়ে গিয়েছিল মানুষের তাজা রক্ত।কোথাও পা দেয়ার জায়গা নেই।চুকনগর বাজারের অলিতে গলিতে শুধু লাশ আর লাশ।হানাদার বাহিনীর বর্বর পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের পর চুকনগর বাজার শকুন ও কুকুরের দখলে চলে যায়।অনেক মৃতপ্রায় ব্যক্তিকে নিয়ে টানাটানি করেছে শকুন আর কুকুর।এই করুণ দৃশ্য কখনও ভুলবার নয়।শত শত বছর ধরে এই হত্যাকান্ডের তথ্য মানুষ স্মৃতিতে রাখবে।সেদিন চুকনগরে প্রায় ৯/১০ হাজারের মত মানুষকে তারা নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে জানা গেছে।সেদিনের এ নৃশংস ঘৃন্যতম দৃশ্য পৃথিবীর ইতিহাসে সব গণহত্যার চেয়ে বর্বর বলে অনেক বিশেষজ্ঞরা বলেছেন।পৃথিবীর ইতিহাসে এটি নিষ্ঠুর ও জঘন্যতম দিন।এদিনটি শুধু চুকনগরের জন্য নয় বাংলাদেশের জন্য একটি ভয়াল ও শোকাবহ দিন।পৃথিবীর ইতিহাসে এটি নিষ্ঠুর ও জঘন্যতম দিন।কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য চুকনগর গণহত্যার ঘটনাটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্থান পায়নি।এজন্যে এদিনটিকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানিয়েছেন এলাকার সর্বস্তরের মানুষ।
এদিকে দিবসটি পালন উপলক্ষে আজ সকাল ৯ টায় চুকনগর গুহত্যা”৭১ স্মৃতিরক্ষা পরিষদের উদ্যোগে চুকনগর কলেজে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
Leave a Reply