যেখানেই ডাক্তার সেখানেই ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম!!!
সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল যেন ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের নিজের বাড়ী
জাহাঙ্গীর সরদার: সাতক্ষীরা পৌরসভার কাটিয়া লস্করপাড়া এলাকার গৃহবধূ মেহেরুন্নেসা। শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টার দিকে ডাক্তার দেখাতে এসেছিলেন সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে সকাল ১১ টার দিকে একজন ডাক্তারের রুমে ঢুকে তাকে দেখালেন। যেয়ে দেখলেন ডাক্তার সাহেবের সাথে কথা বলছেন ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিরা। সেই ফাঁকে মেহেরুন্নেসার কাছে তার শারিরীক অবস্থা শুনে প্রেসক্রিপশন করে দিলেন ডাক্তার। প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে না আসতেই তাকে ঘিরে ধরলেন ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিরা। শুরু করলেন প্রেসক্রিপশন নিয়ে টানাটানি। কে কার আগে ছবি তুলতে পারেন চললো সেই প্রতিযোগিতা। কোনরকম অনুমতি না নিয়েই হাত থেকে কেড়ে নিয়ে একেকজন ছবি উঠানো শেষে মেহেরুন্নেসাকে বাদ দিয়ে তারা আবার চলে গেলেন অন্য রোগীর কাছে। সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন হিসেবে ডা. সবিজুর রহমান যোগদানের পর থেকে ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের এমন দৌরাত্ম সবচেয়ে বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃহস্পতিবার(১১মে) সকাল ১১ টার দিকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের ইনডোরে, বিকালে জরুরী বিভাগে ও ওয়ার্ডে যেয়ে ওই দৃশ্য দেখা গেছে। শুধুমাত্র ইনডোরেইনা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম সমগ্র সদর হাসপাতাল জুড়ে।যেখানেই ডাক্তার সেখানেই ভিড় করছেন ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিরা। এছাড়া মটর সাইকেল গ্যারেজে মটর সাইকেল না রেখে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল প্রাঙ্গনকে তারা বানিয়ে ফেলেছেন মটর সাইকেল গ্যারেজ। ইচ্ছেমতো যেখানে সেখানে তারা রাখছেন মটর সাইকেল। বিশেষ করে সদর হাসপাতালের বি বøকের সামনে সারি সারি মটর সাইকেল রেখে একবোরে প্রবেশপথ আটকে রাখছেন। ফলে চলাচলের অসুবিধা হচ্ছে প্রতিদিন সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে আসা হাজার হাজার রোগী ও তাদের স্বজনদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সকাল হতে না হতেই স্কয়ার, ইনসেপটা, এরিষ্টোফার্মা, হেলথ কেয়ার, অপসোনিন, বেক্সিমকো, রেনেটা, এসকেএফ, একমিসহ শতাধিক ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিরা ইনডোরের ডাক্তারদের চেম্বারের সামনে হাজির হন। ডাক্তার চেম্বারে বসতেনা বসতেই নিজেরা পালাক্রমে ঢুকে পড়েন ডাক্তারের চেম্বারে। শুরু করেন খোঁশগল্প। আর বিভিন্ন উপঢৌকন, স্যাম্পল এবং নানা রকম সুবিধা দেওয়ার আশ্বাসে নিজের কোম্পানীর ঔষধ লিখতে ডাক্তারদের প্রলুব্ধ করেন। নানা রকম সুবিধা নিয়ে ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের কথামতো ডাক্তাররাও রোগীদের প্রেসক্রিপশনে ঔষধের নাম লেখেন। শুধুমাত্র শনিবার ও মঙ্গলবার দুপুর দেড়টার পর ডাক্তারদের ভিজিট করতে পারবেন সিভিল সার্জনের পক্ষ থেকে এমন নির্দেশনা আছে ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের। তবে সেই নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রতিদিনি তারা হাজির হচ্ছেন সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সদর হাসপাতালে সংশ্লিষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে প্রবেশ করে যাতে ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিরা কোন রোগীর কাছ থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে ছবি তুলতে না পারেন সে ব্যাপারে আরএমওসহ যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারাও সুবিধা নেন ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের কাছ থেকে। ফলে নির্দেশনাকে থোড়াই কেয়ার করে সদর হাসপাতালকে নিজেদের বাড়ি মনে করে ইচ্ছামতো প্রবেশ করে সুবিধা নিচ্ছেন এবং হাসপাতালের গুটি কতক ব্যক্তিকে সুবিধা দিচ্ছেন ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিরা।’
মেহেরুন্নেসার বোন নাজমা খাতুন বলেন, ‘ডাক্তার দেখিয়ে বের হবার সাথে সাথে ঔষধ কোম্পানীর লোকসহ পঙ্গপালের মতো এসে আমার বোনকে ঘিরে ধরে প্রেসক্রিপশন কেড়ে নিয়ে ছবি তুলতে শুরু করে। রোগীদের গোপনীয় অনেক বিষয়ও থাকতে পারে। সেটা তারা বুঝছে না। রোগীদের সাথে এমন করলে এই হাসপাতালের সুনাম একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে। আমরা এর প্রতিকার দাবী করছি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধি বলেন, ‘টার্গেট পূরণ করতেই রোগীর কাছ থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে নিশ্চিত হতে চান কোন কোন কোম্পানীর ঔষধ লেখা হয়েছে। নিজের পদোন্নতি এবং চাকরি টিকিয়ে রাখতেই ব্যবস্থাপত্রের ছবি তুলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেন। ঔষধ লেখার কারণে ডাক্তারদের প্রতিমাসে কোম্পানী থেকে উপঢৌকন দেওয়া হয়। যে ডাক্তার যত বেশি ঔষধ লেখেন, তাদেরকে তত বেশি উপঢৌকন দেওয়া হয়।’
সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা. সবিজুর রহমান বলেন, ‘ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের হাসপাতালের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে কোন রোগীর কাছ থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে ছবি তোলার সুযোগ নেই। তাছাড়া তারা সপ্তাহে শনিবার ও মঙ্গলবার দুপুর দেড়টার পর ছাড়া কোন ডাক্তার ভিজিট করতে পারবেন না। আমি বারবার এ ব্যাপারে তাদেরকে নির্দেশনা দিয়েছি। তবে তারা যদি এই নির্দেশনা পালন না করেন তবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
Leave a Reply