মুফতি আলাউদ্দিন আল আজাদ, শ্যামনাগরী
প্রিয় সুধী! সম্মানিত মহিমান্বিত দশটি দিন, দশটি রাত, আর এই দশকের মধ্যে আছে লাইলাতুল কদর। আল্লাহর কাছে অনেক প্রিয় ও বরকতময়। এই রাত পাওয়ার জন্য প্রত্যেক মুসলমানেরই প্রবল চেষ্টা করা উচিত। আর এর সর্বোত্তম পন্থা হলো ইতেকাফ।
ইতিকাফ শব্দের অর্থঃ- হচ্ছে, কোন স্থানে অবস্থান করা। শরীয়তের পরিভাষায়ঃ-যে মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে নিয়মিত আদায় করা হয়। সে মসজিদে আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে নিয়ত সহকারে অবস্থান করাকে এতেকাফ বলে। মহিলাগণ ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে ইতেকাফের নিয়তে অবস্থান করাকে এতেকাফ বলে।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, আর যতক্ষণ তোমরা এতেকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান করো, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সাথে মিশনা।
(সূরা বাকারা ৯৪) মাছওয়ালাঃ ইতেকাফের অবস্থায় খানাপিনার হুকুম সাধারন রোজাদারের মতই, তবে স্ত্রী সহবাসের ব্যাপারে এ অবস্থায় পৃথক নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে যে এতেকাফ অবস্থায় এটা রাতের বেলায় ও জায়েয নেই। উক্ত আয়াতে সে বিধান বর্ণিত হয়েছে।
এতেকাফের ফজিলত: আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত নবী কারীম সাঃ ইতেকাফকারী সম্পর্কে বলেছেন,সে গুনাহ থেকে বেচে থাকেএবং তার জন্য নেকি লেখা হয় ওই ব্যক্তির ন্যায় যে যাবতীয় নেক কাজ করে।মেশকাত -২০০৬. রাসুল সাঃ বলছেন
ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এক দিন এতেকাফ করবে আল্লাহ তা’আলা তাঁর ও জাহান্নামের মধ্যে তিন খনদক পরিমাণ দূরত্ব সৃষ্টি করেন।( তাবরানী) এতেকাফ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন যে ব্যক্তি রমজানের ১০ দিন এতেকাফ করে,২ হজ্ব ও ২ ওমরার সমান সওয়াব পাবে। (বাইহাকি) হযরত আয়েশা (রাঃ)থেকে বর্ণিত আছে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বরাবর রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করেছেন। যতক্ষণ না আল্লাহ তাআলা তাকে উঠিয়ে নিয়েছে এবং তারপর তার স্ত্রী গন রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করেছেন। (মিশকাত ১৯৯৬)
যেহেতু লাইলাতুল কদর নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি সুতরাং যে ব্যক্তি রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করিবে সে অবশ্যই এ মহান রাত লাভ করবে, রমজানের শেষ দশ দিন একাধারে ইবাদাত-বন্দেগী করতে থাকলে যে রাতে শবে কদর হোক না কেন সে উক্ত রাতে এবাদত করে কদরের লাভে লাভবান হতে পারবে। হুজুর সাঃ রাত্রির তালাসে পুরো রমজান মাসে এতেকাফ করেছিলেন।
যেমনঃ হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, একবার নবী কারীম সাঃ রমজানের প্রথম দশক এতেকাফ করলেন, তারপর মধ্যম দশকে করলেন, একটি তুর্কি তাঁবুতে। এ সময় একবার মাথা বের করে বললেন আমি রাত্রির তালাশ করতে গিয়ে প্রথম দশকে এতেকাফ করেছি অতপর মধ্যে দশকে ইতিকাফ করেছি। স্বপ্নে আমার নিকট কেউ এসে বলল এটা শেষ দশকে। অতএব যে ব্যক্তি আমার সাথে প্রথমে এতেকাফ করেছে সে যেন শেষ দশকে ইতিকাফ করে। (মিশকাত ১৯৮৬ বুখারী মুসলিম)
ইতিকাফের প্রকারভেদ। ইতিকাফ ৩ প্রকার: ১.ওয়াজিআ ইতিকাফঃ- ইতিকাফ করার মানত করলে উক্ত এতেকাফ করা ওয়াজিব। এই ইতিকাফ রমজান মাসে বা অন্য কোন মাসে ও আদায় করতে পারে। ২. সুন্নাত ইতিকাফঃ- রমজান মাসের শেষ দশদিন এতেকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। এই সুন্নাত কেউ আদায় করলে সকলের দায়িত্ব মুক্ত হবে অন্যথায় সকলের সুন্নাত ছাড়ায় গুনাহগার হবে। রমজানের শেষ দশ দিন প্রত্যেক মসজিদে কমপক্ষে এক ব্যক্তি হলেও এতেকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কেফায়া। ৩. নফল ইতিকাফঃ- ওয়াজিব ও সুন্নত ইতিকাব ব্যতীত অন্য যেকোনো সময়ের এতেকাফ নফল।
ইতিকাফের শর্তাবলী : (১) মুসলিম হওয়া। (২) জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া। (৩) বালেগ হওয়া। (৪) এতেকাফের নিয়ত করা। (৫০ শরীর পবিত্র হওয়া। ফরজ গোসলের প্রয়োজন হলে অথবা মহিলাগণ হায়েজ নেফাস থেকে পবিত্রতা অর্জন করলে আগে গোসল করে নিতে হবে তারপর পবিত্র অবস্থায় এতেকাফ করবে। (৬) পুরুষের জন্য মসজিদে মহিলাদের জন্য ঘরের মধ্যে নামাজের জন্য নির্ধারিত স্থানে।
হযরত আয়েশা (রাঃ)বলেন নবী করীম সাল্লাল্লাহু সাল্লাম যখন এতেকাফ করতেন মসজিদ থেকে আপন শির মোবারক আমার দিকে বাড়িয়ে দিতেন আর আমি তা আচড়িয়ে দিতাম, কিন্তু তিনি মানবীয় প্রয়োজন ব্যতীত কখনো ঘরে আসতেন না। মেশকাত (১৯৯১)বুখারী মুসলিম।
ইতিকাফের মাসায়েল: মাসালাঃ-মসজিদের ভেতর পর্দা দিয়ে থাকা খাওয়া ও শোয়ার ব্যবস্থা করবে। মাসালাঃ-শরয়ী জরুরত ব্যতিত মসজিদ থেকে বের হলে ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। মাসালাঃ- পেশাব-পায়খানায় ও ফরজ গোসলের জন্য বের হতে পারবে। মাসালাঃ এতেকাফের অবস্থায় দুনিয়ার কাজ কর্মে লিপ্ত হওয়া মাকরূহ। মাসালাঃ- শরীর পরিষ্কার করা ভালো কাপড় পরা সুগন্ধি ব্যবহার করা, চুল আচড়ানো,নখকাটা জায়েজ আছে। মাসালাঃ- ইতিকাফ অবস্থায় বেচাকেনা করা ও খারাপ কথাবার্তা বললে ইতিকাফ মাকরূহ হয়। তবে জীবনের আবশ্যিক প্রয়োজনে জরুরি বেচাকেনা জায়েজ আছে। শর্ত হলো পণ্যসামগ্রী মসজিদের বাইরে থাকতে হবে। কিন্তু মসজিদকে ব্যবসা ক্ষেত্রে পরিণত করা জায়েয নয়।
ইতিকাফ অবস্থায় করণীয় আমল; ১. দীনি মাসায়েল শিক্ষাদান করবে ওর শিক্ষা গ্রহণ করবে। ২. কোরআন তেলাওয়াত করবে। ৩.যিকির ও তাসবিহ পড়বে। ৪. ধর্মীয় বিষয়ে গবেষনা রচনা ও প্রচারণা কাজ করবে। ৫.বেশি বেশি করে নিজের জন্য মা-বাবা আত্মীয়-স্বজন এবং বিশ্ব মুসলিমের জন্য দোয়া করবে। ৬.একেবারে চুপচাপ থাকবে না।
যেসব কারণে ইতিকাফ ভঙ্গ হয়: ১. শরয়ী অনুমোদিত প্রয়োজন ছাড়া মসজিদের বাইরে গেলে। ২. স্ত্রী সহবাস করলে। ৩. মহিলাদের হায়েজ নেফাস হলে। ৪. ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হলে।
আসুন আমরা যারা পারি তারা পরিপূর্ণ দশ দিন এতেকাফের নিয়তে মসজিদে চলে আসি। আর যারা তা না পারি কমপক্ষে বেজোড় রাত গুলো মসজিদে এসে এবাদত করার চেষ্টা করি। মসজিদের দোয়ার সকলের জন্য উন্মুক্ত। আল্লাহর রহমতের দরজা আপনার জন্য খুলে যাবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমিন খতিব,কোনাবাড়ী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, গাজীপুর ঢাকা।
Leave a Reply