নিজস্ব প্রতিনিধি: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামাল আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, আপনাদের ব্যক্তিত্ব, নৈতিকতা এমন হওয়া উচিৎ যেন অন্যরা আপনাদেরকে অনুসরণ করেন। তিনি তরুণ আইনজীবীদেরকে বলেন, আপনারা যদি আইন পেশাকে মনে করেন এটি ব্যবসা, এটি আয়ের বিষয়, এটি ধনী হওয়া বা বাড়ি-গাড়ি করার একটি বিষয় তাহলে দয়া করে আপনারা অন্য কোথাও যান। আমি নিজেও একজন আইনজীবী ছিলাম উল্লেখ করে তিনি আইনজীবীদেরকে বলেন, আপনাদের কাছে অনুরোধ করবো, এটি একটি অত্যন্ত সম্মানজনক পেশা।
আপনারা বিজ্ঞ, বিজ্ঞ শব্দটা বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর অন্য কোন ব্যক্তির সামনে ব্যবহার করা হয়না, শুধু আইনজীবীদের সামনে এটি ব্যবহার করা হয়। আপনাদেরকে সমাজ, দেশ, আইন এতবড় একটা সম্মান দিল সেই সম্মান আপনাদেরকে রাখতে হবে, রাখা আমাদের দায়িত্ব, আমাদের কর্তব্য। এই সস্মান কিভাবে রাখা যায় সে ব্যাপারে সম্প্রতি তাঁর দেওয়া এক রায়ের কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বিচারক জুডিসিয়ারী না, আইনজীবী জুডিসিয়ারী না, বিচারক এবং আইনজীবী একত্রে জুডিসিয়ারী। বিচারক এবং আইনজীবীর সম্মিলিত ব্যবস্থাটাই জুডিসিয়ারী।
তিনি মোয়াক্কেলদের সাথে একজন আইনজীবীর আচরণ কেমন হওয়া উচিৎ তা উল্লেখ করে বলেন, আপনারা যখন ডাক্তার সাহেবদের কাছে আপনার বাবা-মাকে দেখাতে নিয়ে যান, তখন অনেকটা অসহায় হয়ে প্রশ্ন করেন, আমার মা ভলো হবেতো? কিন্তু একজন ডাক্তার যদি আপনার সাথে সুন্দর ব্যবহার না করেন, তিনি যদি অপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পরীক্ষ-নিরীক্ষা দিয়ে আপনাকে র্জজরিত করেন, আপনি সেই ডাক্তারকে কি করতেন?
একই ভাবে আপনার সামনে যে লোকটিকে আজকে থেকে দেখবেন, ভাববেন সেও একজন রুগী, তাকে সর্বোচ্চ সম্মান করে, তার কথা আন্তরিকতার সাথে শুনে যদি মামলাটি চলার উপযুক্ত না হয় ছেড়ে দেন, আল্লাহ আপনাকে চালাবে। যে মামলাটি আসলে চলেনা, সেটিও করে দিলেন, তাকে (মোয়াক্কেলকে) যেমন ক্ষতি করলেন, আদালতে মামলাজট বাড়ালেন। তিনি আরও বলেন, শুধু বাংলাদেশ কেন, আমেরিকা, বৃটেনসহ বিশ্বের যেকোন দেশের সম্মানী পেশার চেয়ে আপনাদের পেশা অনেক সম্মানের। আপনাদের এই আকাশচুম্বী সম্মানটা ধরে রাখতে হলে আপনাদেরকে স্মার্ট হতে হবে। তিনি বলেন, আমি যখন তরুণ আইনজীবী ছিলাম, আমার টাকা ছিলনা। কিন্তু তারপরও আমি প্রতিদিন জুতা পালিশ করাতাম। কারন স্মার্ট না থাকলে মোয়াক্কেল আমার ভালো ফি দিবেনা। বিচারপতি আরও বলেন, আমি সেইদিন নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করবো, যেদিন অন্য পেশার সবাই আপনাদেরকে সম্মান করবে।
তিনি আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে বলেন, মানুষ মামলা করতে আসলেই মিমাংসা করার চেষ্টা করুন। আপনারা আজকে থেকে নিজেকে একজন বিচারক হিসেবে ভাবুন। উভয় পক্ষের আইনজীবী বসে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করে দিন। কোর্টেতো ৩০ বছরেও মামলা শেষ হয়না। দুই পক্ষ বসে সমাধানটা করে দেন, সেক্ষেত্রে ফি’ও বেশী পাবেন।
তিনি প্রচলিত আইন ব্যবস্থা সম্পর্কে বলেন, এটি কার্যত: অচল হয়ে গেছে। কারন এই বিচার ব্যবস্থা মানুষকে মুক্তি দিতে পারছেনা। ৩০ বছর, ৪০ বছর পর বিচার পেয়ে কি হবে? এর মধ্যে তার (মোক্কেলের) জীবনটাতো শেষ হয়ে যায়। তিনি আমেরিকা, কানাডার কথা উল্লেখ করে বলেন, সেখানে ৯০ ভাগ আইনজীবীর কাজ হচ্ছে আপোষ-মিমাংসার মাধ্যমে বিরোধ নিস্পত্তি করা। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের প্রত্যেকটা আইনেই এখন আপোষ-মিমাংসার কথা বলা আছে, আইনজীবীরাইতো বিচারক, তাঁদের মধ্য থেকেই তো বিচারক হয়, তাহলে কেন আপনারা আপোষ করতে পারবেন না?
তিনি বুধবার দুপুরে সাতক্ষীরা জেলা আইনজীবী সমিতির উদ্যোগে দেওয়া সংবর্ধনার জবাবে এসব কথা বলেন। সমিতি পরিচালনা কমিটির আহবায়ক ও জিপি এড. শম্ভুনাথ সিংহ’র সভাপতিত্বে এবং পিপি এড. আব্দুল লতিফ এর সঞ্চালনায় সংবর্ধনা সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, সাতক্ষীরার সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ চাঁদ মোহাম্মদ আব্দুল আলিম আল রাজী এবং বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্টার আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকী।
বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) এম, জি আযম ও চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সুমি আহমেদ। এছাড়া বক্তব্য রাখেন, বারের সাবেক সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী আব্দুল মজিদ এবং সিনিয়র আইনজীবী সৈয়দ এখলেছার আলী বাচ্চু। এসময় বিচার বিভাগ, সাতক্ষীরার সকল বিচারকবৃন্দ এবং আইনজীবীগন উপস্থিত ছিলেন।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষে বারের পক্ষ থেকে বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামালকে সুন্দরবনের ঐতিহ্য বাঘের প্রতিকৃতি উপহার দেওয়া হয়।
Leave a Reply