শ্যামনগর প্রতিনিধি: শ্যামনগর জন্মলগ্ন থেকে কৃষিভিত্তিক এলাকা হিসেবে বিবেচিত। এ অঞ্চলের অর্থনীতি আদিকাল হতে মূলত কৃষি নির্ভর। নিকট অতীতের শেষ চার দশকে লবণ পানিতে মৎস্য চাষ ও সাম্প্রতিক সময়ে স্বল্প সংখ্যক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও অদ্যাবধি কৃষি-ই এই এলাকার মেরুদন্ড। প্রায় সাড়ে চারশ’ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সমুদ্রপাড়ের এ জনপদের শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ এখনও প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। মোট জিডিপিতে কৃষির অবদান প্রায় ২২ শতাংশ হওয়ায় জাতীয় অর্থনীতিতে সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগরের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। কৃষি উৎপাদন হ্রাস বৃদ্ধির উপর নির্ভর করে অন্যতম ঘনবসতিপুর্ন এ অঞ্চলের অর্থনীতি এখনও নির্ধারিত হয়। প্রায় সাড়ে তিন লাখ জনগোষ্ঠীর শ্যামনগরে প্রতিদিনই নুতন নুতন মুখ যোগ হচ্ছে। প্রায় একই গতিতে একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে আত্মপ্রকাশ ঘটছে নিত্য নুতন পরিবারের। জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান এ চাপ কৃষি নির্ভরতার সুযোগে নিশ্চিতভাবে এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে চলেছে।
২০১৯ সালের কৃষি শুমারীর তথ্য মতে সুন্দরবনসংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলায় মোট কৃষি জমি রয়েছে ৬০ হাজার ৭৩ একর। অথচ ২০০৮ সালে একই অংশে কৃষি জমির পরিমান ছিল প্রায় ৭৮ হাজার ৬৮৩ একর। তুলনামুলক বিচারে স্পষ্ট প্রতীয়মান যে মাত্র ১০/১২ বছররের ব্যবধানে প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার একর কৃষি জমি অকৃষিখাতে চলে গেছে। একই সময়ে প্রায় পনেরো হাজার পরিবার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে তা বতর্মানে ৮৩ হাজারে পৌঁছেছে। জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমান এ চাপের ফলে ২০৩০ সাল নাগাদ কৃষি জমি প্রায় ৩০ হাজার একরে নেমে আসার শংকা বিশিষ্টজনদের। অব্যাহতভাবে কৃষিজমি একই গতিতে অকৃষিখাতে চলে গেলে অদুর ভবিষ্যতে মুল নির্ভরতার জায়গা কৃষি নিয়ে মারাত্মক সংকট তৈরীর সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। অপর এক সমীক্ষায় দেখা যায়, শ্যামনগরের প্রায় সাড়ে তিনলাখ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক লাখ আশি হাজার নারী ও পুরুষ সরাসরি কৃষির সাথে জড়িত। মূলত কৃষিভিত্তিক চাষাবাদসহ কৃষি তাদের জীবন-জীবিকার অন্যতম নির্ভরতার জায়গা। শ্যামনগরের প্রেক্ষাপটে দিনে দিনে সে নির্ভরতা না কমে বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার প্রেক্ষিতে বর্ধিত জনসংখ্যার চাপ ও চাহিদা মেটাতে কৃষি প্রধান এ অঞ্চলের বিগত দিনের এক ফসলী জমি হতে দু’তিনটি ফসল পাওয়ার উপায় খুঁজছে স্থানীয়রা।
তবে শ্যামনগরের কৃষি জমি শুধু খাদ্য চাহিদা মিটানো আর অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখছে এমন নয়। বরং কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন, মানবসম্পদ উন্নয়নের পাশাপাশি স্থানীয় প্রাণ- প্রকৃতি আর জীব বৈচিত্র রক্ষায়ও তার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। সার্বিক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, স্থানীয় অর্থনীতির মেরুদন্ড কৃষি আজ চ্যালেঞ্জের মুখে। দিন দিন কৃষি জমি চলে যাচ্ছে অকৃষি খাতে। আবার বৈশি^ক জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জলবায়ু নির্ভর স্থানীয় কৃষির উপর। এসব নানাবিধ প্রতিকুলতায় স্থানীয় অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি কৃষি উৎপাদন হ্রাসের সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে। আর কৃষি উৎপাদনে বিপর্যয় ঘটলে সুন্দরবনসংলগ্ন শামনগরের সামাজিক অর্থনীতি তথা অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ারও শংকা রয়েছে। নানা শ্রেণীপেশার মানুষ ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাখে কথা বলে স্পষ্ট ধারণা তৈরী হয়েছে যে এ অঞ্চলের কৃষিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে মূলত পরিবর্তিত জলবায়ু পরিস্থিতি ও কৃষি জমি হ্রাসের ঘটনা। তবে জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় নানামুখী পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা চললেও কৃষি জমি সংরক্ষণের বিষয়ে সমন্বিত তেমন কোন উদ্যোগ নেই। এদিকে কৃষি জমির যথাযথ ব্যবহার ও সংরক্ষণ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন আইন না থাকায় অকৃষি খাতে কৃষি জমির যথেচ্ছা ব্যবহারে লাগাম টানা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় কৃষি নির্ভর অর্থনীতিতে সম্মৃদ্ধ দক্ষিণ-পশ্চিম উপকুলীয় গুরুত্বপূর্ণ এ জনপদের জন্য কৃষি জমির সংকট আগামীতে মারাত্বক পরিণতির ভীতি ছড়াচ্ছে।
যেসব কারণে কৃষি জমি কমছে: কৃষি জমি হ্রাসের কারন অনুসন্ধানে স্পষ্ট দেখা যায় নুতন বসতি স্থাপনসহ রাস্তা-ঘাট-অবকাঠামো নির্মাণ কাজে উপকূলবর্তী শ্যামনগর উপজেলার সবচেয়ে বেশি কৃষি জমি হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া কল-কারখানা ও ইটভাটা স্থাপনসহ নদী ভাঙনের পাশাপাশি অপরিকল্পিত চিংড়িচাষ কৃষি জমি কমার অন্যতম কারন। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায় অব্যাহতভাবে কৃষি জমি কমতে থাকায় স্থানীয় নাগরিক জীবনে তার স্পষ্ট প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। মাথাপিছু কৃষি জমি কমে যাওয়ার পাশাপাশি অনুকুল পরিবেশের অনুপস্থিতিতে প্রকৃতি তার স্বরুপ হারাচ্ছে। অপরিকল্পিত জনবসতি গড়ে উঠার দরুণ পারিপাশির্^ক অবস্থার প্রেক্ষাপটে অবশিষ্ট কৃষি জমির উর্বরতা হ্রাসসহ উৎপাদনের মাত্রাও আনুপাতিকহারে কমতে শুরু করেছে। এমনকি মাথাপিছু কৃষি জমির পরিমান কমতে থাকায় স্থানীয় পর্যায়ে দরিদ্রতার হার বৃদ্ধিসহ সর্বত্র সামাজিক অস্থিরতা তৈরী হচ্ছে।
সামগ্রিক পর্যবেক্ষনে দেখা যায় কৃষি বা আবাদি জমি কমার অন্যতম কারন হলো অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ। শিল্পায়ন ও নগরায়ন কৃষি জমির উপর প্রভাব ফেললেও মুলত ক্রমবর্ধমান জনসখ্যার চাপ ঠেকাতে যেয়ে প্রতিনিয়ত কৃষি জমি ভাগ হচ্ছে। নুতন বাড়িঘর ও পুকুর জলাশয় আর নিত্য নুতন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে যেয়ে মূল আঘাত আসছে কৃষি জমির উপর। আর কৃষি জমি কমে যাওয়ায় স্থানীয় পর্যায়ে ধানসহ অন্যান্য খাদ্যশষ্যের উৎপাদনেও ঘাটতি তৈরী হচ্ছে।
একথা স্বীকার্য্য যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সড়ক একটি গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা পালন করে। এসব সড়ক ও রাস্তা তৈরীতে স্থানীয় কৃষি জমির বড় একটি অংশ ব্যবহার হচ্ছে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে গড়ে উঠা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো শতভাগ কৃষি জমির উপর নির্ভর করেছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত কয়েক দশকের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হয়ত একটি স্থিতিশীল অবস্থায় চলে আসবে। কিন্তু ক্রমাগতভাবে কমতে থাকা কৃষি জমির সংকট ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তাসহ বাস উপযোগী জনপদ গড়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ভুক্তেভোগীসহ নানা শ্রেণির পেশার মানুষ ও বিশিষ্টজনের সাথে কথা বলে স্পষ্ট ধারনা মেলে যে ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর চাপ সামলোতে যেয়ে মূলত আশংকাজনকহারে কৃষি জমি হারিয়ে যাচ্ছে। এখনই অকৃষি খাতে কৃষি জমির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে অদুর ভবিষ্যতে তা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। যেসব কারণে কৃষি জমি কমছে সেগুলো নি¤œরুপ:- *নদী ভাঙন: বঙ্গপোসাগর তীরবর্তী শ্যামনগরের কৃষি জমি কমার গুরুত্বপূর্ণ আরও একটি কারণ অব্যাহত নদী ভাঙন। দেশের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের সবশেষ জনপদের তিন পাশ নদী বেষ্ঠিত হওয়ার সুযোগে নদী ভাঙন এখানকাল অন্যতম সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকাসহ বিভিন্ন অংশ দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীসমুহের করাল গ্রাসে উল্লেখযোগ্য পরিমান কৃষি জমির হারিয়ে যাচ্ছে অব্যাহতভাবে। আবার লবন পানি দিয়ে অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ আর সময়মত ড্রেজিং না হওয়ায় বিগত তিন/চার দশকে নদী ভ্ঙানের কবলে পড়ে এ অঞ্চলের মোটা দাগে কৃষি জমির অস্থিত্ব বিলীন হয়ে গেছে।
*অপরিকল্পিত নগরায়ন: শ্যামনগরে কৃষি জমির কমার অন্যতম প্রধান কারন হচ্ছে অপরিকল্পিত নগরায়ন। বর্ধিত জনসংখ্যার চাপে প্রতিনিয়ত নুতন নুতন আবাসস্থলের সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু নির্দষ্ট কোন কর্তৃপক্ষের তদারকি না থাকায় অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা এসব ঘর-বাড়ি ও বসতির কারনে প্রচুর কৃষি জমি নষ্ট হচ্ছে।
*অধিগ্রহণ: সরকারি নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়নসহ উন্নয়ন অবকাঠামো গড়ে তুলতে জমি অধিগ্রহণের প্রথা রয়েছে। কৃষি জমি ছাড়া অপরাপর অংশের ভুমি অধিগ্রহণে মূল উদ্দেশ্যে সফলতা মিলছে না। বাধ্য হয়ে এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে জমি অধিগ্রহণ করতে যেয়ে শ্যামনগরের অনেক কৃষি জমি হারিয়ে যাচ্ছে।
*নুতন বসতি স্থাপন: প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক পরিবার থেকে নুতন নুতন পরিবারের জম্ম হচ্ছে। আর বৃদ্ধি পাওয়া এসব পরিবারের জন্য নুতন বসতি স্থাপনের স্বার্থে কৃষি জমির উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। নুতন নুতন ঘরবাড়ি এবং এসব পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে যেয়ে পুকুর জলাশয় তৈরীতে কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে।
*রাস্তাঘাট নির্মাণ: জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে গড়ে উঠছে নুতন নুতন স্থাপনা ও বসতি। আর সেসব অংশে নুতনভাবে রাস্তাা-ঘাট নির্মানের স্বার্থে কৃষি জমি ব্যবহার করা হয়। এছাড়া অর্থনীতিকে গতিশীল করার স্বার্থে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে যেয়ে বিভিন্ন এলাকার নিত্য সড়ক নির্মান ও সম্প্রসারণে কৃষি জমির উপর নির্ভর করা হচ্ছে।
*আইনের অভাব: অকৃষি খাতে কৃষি জমি ব্যহারের বিষয়ে সুস্পষ্ট আইন থাকা দরকার। এধরনের আইন ও তার প্রয়োগ না থাকায় না ভুমি মালিক ও ক্রেতারা ইচ্ছামত কৃষি জমিকে যথেচ্ছা ব্যবহার করছে। যা সমগ্র এলাকাজুড়ে দিনকে দিন কৃষি জমিকে অস্থিত্ব সংকটের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
*পরিকল্পনাহীন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গঠন: স্থানীয় পর্যায়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বর্ধিত জনগোষ্ঠীর চাহিদাও বাড়ছে। পরিস্থিতির সাথে তাল মেলাতে যেয়ে প্রতিনিয়ত নুতন নুতন ব্যবসা ও বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে শ্যামনগরের বিভিন্ন প্রান্তে। নুতন প্রতিষ্ঠান গড়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট আইন না থাকার সুযোগে পরিকল্পনাহীনভাবে সেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠায় অনেক অংশের আবাদি জমির পরিমান কমছে।
*জলাবদ্ধতা: প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নদ-নদীর নাব্যতা সংকটের পাশাপাশি আরও কতগুলো কারনে সাম্প্রতিক সময়ে জলাবদ্ধতা এ অঞ্চলের জন্য মারাত্বক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। স্থায়ী এবং অস্থায়ী জলাবদ্ধতার দরুণ স্থানীয় কৃষি জমির বড় একটি অংশ অনাবাদি হয়ে পড়ে থাকছে। আবার লবণ পানি দিয়ে অপরিকল্পিতভাবে চিংড়ি চাষের কারনে শ্যমনগরের অনেক অংশে জলাবব্ধতার সৃষ্টি হয়ে তা কৃষি জমির উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
*ইটভাটা স্থাপন: সুন্দরবনসংলগ্ন জনপদ শ্যামনগরে কৃষি জমি কমার আরও একটি কারন যত্রতত্র ইটভাটা স্থাপন। লোকালয়সহ জনবসতির মধ্যে অপরিকল্পিতভাবে ইটভাটা স্থাপনের সুযোগে কৃষি জমির বড় একটি অংশ হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া ইটভাটার ধোয়াসহ বিষাক্ত কালি ও পানি ছড়িয়ে যেয়ে সংলগ্ন অংশের কৃষিপ্রতিবেশকে ক্ষতিগ্রস্থ করায় আশংকাজনকহারে কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। আবার ইট ভাটার জন্য প্রয়োজনীয় পানি সংরক্ষনের জন্য কৃষি জমিতে পুকুর জলাকার তৈরীর পাশাপাশি কাঁচামাল মাটি সংরক্ষণে কৃষি জমি নষ্ট করা হচ্ছে।
*পুকুর জলাশয় তৈরী: বর্ধিত জনগোষ্ঠী বা নুতন নুতন সৃষ্ট পরিবারগুলোর জন্য যেমন নুতন বসতি স্থাপনের প্রয়োজন পড়ছে। তেমনি এসব পরিবারের জন্য ব্যবহার উপযোগী পুকুর জলাশয় গড়ে তেলার কাজ চলছে হরদম। ফলে নুতন নতন পরিবারের স্বার্থে পুকুর জলাশয় তৈরী করতে যেয়ে মূল কোপ পড়ছে কৃষি জমির উপর।
*লবণ পানির চিংড়ি চাষ: শ্যামনগরে কৃষি জমি কমার অন্যতম প্রধান কারণ হলো লবণ পানির চিড়ি চাষ। নদী থেকে লবণাক্ত পানি উপকূল রক্ষা বাঁধের ভিতরে প্রবেশ করিয়ে মূলত কৃষি জমিতে এই চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে। আশির দশক থেকে স্বল্প পরিসরে লবণ পানির চিড়ি চাষ শুরু হলেও পর্যায়ক্রমে তা ব্যাপক পরিসরে বিস্তার লাভ করেছে। লবণ পানির চিংড়ি চাষ এ এলাকায় কৃষি জমি হ্রাসের পিছনে সবচেয়ে বড় ভুৃমিকা পালন করে চলেছে। অনুসন্ধানকালে দেখা যায় নির্দিষ্ট অংশের জমিতে চিংড়ি চাষের পাশাপাশি তদসংলগ্ন কৃষি জমিতে নানাভাবে সেসব চিংড়ি প্রকল্পের লবন পানি ছড়িয়ে পড়ায় লবণাক্তার কারনে পর্যায়ক্রমে উদ্বৃত্ত কৃষি জমি তার অস্তিত্ব হারাচ্ছে।
*যত্রতত্র বালু উত্তোলন: সরেজমিন পরিদর্শন ও স্থানীয়দের পাশাপাশি পরিবেশবিদদের আলোচনায় উঠে এসেছে যে উপকূলবর্তী জনপদ শ্যামনগরে কৃষি জমি কমে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ আরও একটি কারণ যত্রতত্র বালু উত্তোলন। জলাকার ভরাটসহ উন্নয়ন প্রকল্প সম্পাদনের নামে হাইড্রোগ্রাফিক পদ্ধতির অনুসরণ ছাড়াই এ অঞ্চলের যত্রতত্র বোরিং করে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করা হয়। নির্ধারিত বালুমহালের পরিবর্তে কৃষি জমি ও চিংড়িঘের থেকে বালু উত্তোলনের প্রভাবে বিভিন্ন অংশের মাটি দেবে যেয়ে চাষের জমি কৃষি কাজের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।
*ভাটার কাঁচামাল হিসেবে কৃষি জমির মাটি সংগ্রহ: এছাড়া ইট ভাটার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত মাটি স্থানীয়ভাবে কৃষি জমি কমার আরও একটি কারণ। অনুসন্ধানকালে দেখা যায় শ্যামনগরের স্থায়ী ও অস্থায়ী ইটভাটাসমুহে ব্যবহারের মাটির শতকরা ১০০ ভাগ স্থানীয় কৃষি জমি থেকে সংগ্রহ করা হয়। মাছ চাষের জন্য উপযোগী পুকুর খনন করে দেয়াসহ আর্থিক সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে ভূমি মালিকদের সম্মতিতে কৃষি জমি থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি ঘনফুট মাটি সংগ্রহ করা হচ্ছে। আর এভাবে ইটের কাঁচামাল যোগান দিতে যেয়ে প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য পরিমান কৃষি জমি অকৃষিখাতে চলে যাচ্ছে।
কিভাবে কৃষি জমি কমার সংকট থেকে নিস্কৃতি পাওয়া সম্ভব: উপকূলবর্তী জনপদ শ্যামনগরে যে হারে কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে তা রীতিমত উদ্বেগজনক। আবাদযোগ্য জমি হ্রাসের এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে অনাগত ভবিষ্যতে বিষয়টি মারাত্মক সংকটজনক পরিস্থিতি তৈরী করবে। বাসযোগ্য আবাসভুমি গঠনসহ স্থানীয় জীব-বৈচিত্র আর প্রাকৃতিক পরিবেশ যথাযথ রাখতে কৃষি জমি হ্রাসের লাগাম টানা জরুরী। উপকূলীয় জনপদজুড়ে কৃষি জমি হ্রাসের এ ধারা বন্ধে নিম্মোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা অতীব জরুরী।
*অপরিকল্পিত আবাসন বন্ধে পদক্ষেপ: উপকুলবর্তী জনপদ শ্যামনগরে কৃষি জমি হ্রাস ঠেকাতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন অপরিকল্পিত আবাসন ও বসতি বন্ধ করা। জমির মালিক হলেই যেন কেউ ইচ্ছামত জমি ব্যবহার করে বাড়ি-ঘর বা স্থাপনা তৈরী করতে না পারে সেবিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। আইনের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসনের তদারকি ও অনুমোদন নিয়ে নীতিমালার আওতায় নুতন বাড়িঘর স্থাপনের সুযোগ রাখতে হবে। তাতে যত্রতত্র বাড়ি ঘর ও পুকুর জলাশয় নির্মান বন্ধ হলে কৃষি জমি কমার হার কমে আসবে।
*অপরিকল্পিত এবং লবন পানির চিংড়ি চাষ বন্ধ: কৃষি জমি রক্ষার অত্যন্ত কার্যকরী পদক্ষেপ হতে পারে অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ বন্ধ করা। ‘আধা নিবিড়’ পদ্ধতিসহ বৈজ্ঞানিক উপায়ে চিংড়ি চাষ করলে বিস্তীর্ণ এলাকায় লবণ পানির রাজত্ব বন্ধ হবে। সেক্ষেত্রে মাঠের পর মাঠ লবণ পানির আগ্রাসন থেকে রক্ষা পাওয়ার মাধ্যমে কৃষি জমি হ্রাসের হার দারুণভাবে কমে আসবে।
*ইটভাটা নীতিমালা অনুসরণ: কৃষি জমি রক্ষার্থে শ্যামনগরে পরিচালিত সকল ইটভাটাগুলোকে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা মেনে চলার পরিবেশ তৈরী করতে হবে। লোকালয় ও কৃষি জমিতে ইটভাটা পরিচালনা বন্ধের পাশাপাশি সেখানে কাঁচামাল হিসেবে কৃষি জমির মাটি ব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ইট ভাটাসমূহকে নদীর চর এলাকায় পুন:স্থাপন করে পুন:খননকৃত খাল ও নদীর মাটির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া ইট ভাটার কারণে যেন কৃষি জমির ফসল উৎপাদনে প্রভাব না পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ইটভাটা পরিচালনার ক্ষেত্রে নীতিমালা অনুসরণে প্রশাসনসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বিশেষ ভুমিকা থাকতে হবে।
*নদী ভাঙন রোধ: উপকূলবর্তী এলাকা হওয়ার পাশাপাশি অপরিকল্পিত চিংড়িচাষের কারণে শ্যামনগরের বিভিন্ন অংশ প্রতিনিয়ত ভাঙনের মুখে পড়ে। বছরের একাধিকবার উপকূল রক্ষা বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ লোকালয় প্লাবিত হওয়ার পর সমগ্র এলাকায় লবন পানিতে তলিয়ে যায়। যার প্রভাব দীর্ঘকাল থাকায় ফসল উৎপাদনের সুযোগ না পেয়ে দিনে দিনে এ অঞ্চলে কৃজি জমিতে লবন পানির চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে। এ প্রবনতা বন্ধে উপকুল রক্ষা বাঁধের ভাঙন রোধসহ লবণ পানির লোকালয় ও কৃষি জমিতে প্রবেশে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
*সড়ক ও রাস্তা-ঘাট নির্মাণে সতর্কতা: আধুনিক জীবন ব্যবস্থার পূর্বশর্ত উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। কিন্তু কৃষি জমি রক্ষার অংশ হিসেবে অপরিকল্পিত সড়ক ও রাস্তা-ঘাট নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রেখে গ্রামীন এ জনপদে সড়ক ও রাস্তা নির্মাণে সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকি থাকা জরুরী। কৃষি জমি বিনষ্ট করে যেন গ্রামীন সড়ক গড়ে না উঠে সেদিকে খেয়াল রেখে স্থানীয়দের জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিতে প্রশাসনহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ‘তদারকি সেল’ গঠন করতে হবে।
*অধিগ্রহণে সতর্কতা: সরকারি স্থাপনা নির্মাণে শ্যামনগরের বিভিন্ন অংশে কৃষি জমি হ্রাসের ধারা অব্যাহত রয়েছে। সামগ্রিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে কৃষি জমি হ্রাসের গতি কমিয়ে আনতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
*সুনির্দিষ্ট আইন তৈরী এবং যথাযথ প্রয়োগ: শুধুমাত্র শ্যামনগর না। বরং বাংলাদেশে কৃষি জমির ধ্বংস কমাতে এখনও পর্যন্ত কোন সুনির্দিষ্ট আইন তৈরী হয়নি। যার ফলে ভূমি মালিকরা ইচ্ছামত যত্রতত্র ঘরবাড়ি ও নানান ধরনের স্থাপনা গড়ছে। আবার কৃষি জমি ধরে রাখার চিন্তা না করে অপরিকল্পিতভাবে লবণ পানি দিয়ে চিংড়ি চাষ এমনকি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। তাই কৃষি জমি রক্ষার্থে সর্বাগ্রে প্রয়োজন কৃষি জমি ব্যবহার নীতিমালা প্রনয়ন। কৃষি জমি রক্ষার্থে আইন প্রনয়ন এবং তার যথার্থ প্রয়োগই কেবল কৃষি জমি সংরক্ষণের প্রধান হাতিয়ার হতে পারে।
*কর আরোপ: কৃষি জমি ক্রয়-বিক্রয়ের পর যাতে সেখানে অপরিকল্পিতভাবে স্থাপনা নির্মানের সুযোগ না নেয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়া ক্রয়-বিক্রয়কৃত জমিতে স্থাপনা নির্মানের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণের পাশাপাশি স্থাপনার ধরণ অনুযায়ী নির্ধারিত হারে কর আদায় করতে হবে।
*পরিকল্পনাহীন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গঠন: কৃষি জমিতে অপরিকল্পিতভাবে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ার বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রশাসনকে কাজে লাগাতে হবে। প্রশাসনিকভাবে গঠিত সুনির্দিষ্ট কমিটির মতামতের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক কাজে কৃষি জমির ব্যবহার সংক্রান্ত আইন করতে হবে। কৃষি জমি বিনষ্ট করে কোন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে না পারে সেজন্য কঠোর ভূমি আইন প্রনয়ন করতে হবে।
*যত্রতত্র বালু উত্তোলন: বালু উত্তোলনের কারণে উপকূলীয় এ জনপদের অনেক স্থানে কৃষি জমি অকৃষিখাতে চলে গেছে। তাই নির্দিষ্ট বালুমহাল থেকে বালু সংগ্রহ করে উন্নয়ন কাজ পরিচালিত করতে হবে। স্থানীয় কৃষি জমি রক্ষায় যত্রতত্র বোরিং করে বালু উত্তোলন বন্ধ করা জরুরী। তবে শুধুমাত্র আইন করে কৃষি জমি রক্ষা করা সম্ভব নাও হতে পারে। সেজন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সসচেতন ও সতর্ক করার পাশাপাশি কৃষি জমি সুরক্ষায় আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কৃষি জমির অভাবে অনাগত ভবিষ্যতে সমুহ বিপদের বিষয়াবলী স্থানীয়দের মধ্যে প্রচার করে কৃষি জমি সুরক্ষায় তাদের অংশগ্রহন নিশ্চিত করতে হবে।
*জলাবদ্ধতা: তিন পাশে নদী বেষ্ঠিত সুন্দরবনসংলগ্ন শ্যামনগরের অন্যতম অভিশাপ এখানকার জলাবদ্ধতা। জলাবদ্ধতার কারণে কৃষি জমির একটি বড় অংশ অনাবাদী থেকে অকৃষি খাতে পড়ে আছে। আবার নানা কারণে সামান্য বর্ষাতে গোটা এলাকার বহু অংশে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। তাই জলাবদ্ধতা দুরীকরণে প্রয়োজনীয় উধ্যোগ নেয়ার ম্যাধমে কৃষি জমি রক্ষায় আন্তরিক হতে হবে।
*পুকুর জলাশয় তৈরী: পরিবার সম্প্রসারিত হওয়ায় নিত্য নুতন বাড়িঘর নির্মিত হচ্ছে। এসব বাড়ি-ঘরে বসবাসরতদের জন্য সেখানে খনন করা হচ্ছে পুকুর জলাশয়। যার সম্পূর্ণ প্রভাব পড়ছে কৃষি জমির উপর। তাই কৃষি জমি সুরক্ষার অংশ হিসেবে নুতন নুতন বসতবাড়ি নির্মানে যেমন পরিকল্পনা তাকা দরকার, তেমনি প্রতিটি পরিবারের জন্য পৃথক পুকুরের বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করে কৃষি জমি রক্ষার চেষ্টা করা যেতে পারে।
Leave a Reply