কাজী মারুফ হোসেন সাতক্ষীরা থেকে: রোযা ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের একটি এবং ঈমানের এক- চতুর্থাংশ। কেননা, এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, ‘আসসাওমু নিসফুস সবরে’ অর্থাৎ রোযা সবরের অর্ধেক। অন্য এক হাদিসে বলেন ‘আসসাওমু নিসফুল ইমান’। অর্থাৎ রোযা ঈমানের অর্ধেক। এখানে উল্লেখ্য যে, রোযা ধৈর্যের অর্ধেক।
অপর একটি হাদিসে বর্ণিত রয়েছে, ঈমানের অর্ধেক। সুতরাং বলা যায়, রোযা ঈমানের অর্ধেকের অর্ধেক। অর্থাৎ এক- চতুর্থাংশ। রোজা মহান আল্লাহ তা’ আলার সাথে সম্পর্কযুক্ত সেজন্য ইসলামের সকল রোকনের মধ্যে এটা সর্বোৎ কৃষ্ট রোকন। অতএব হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তা’আলার উক্তি নবী করিম (সঃ) বর্ণনা করেছেন। উক্তিটি হলো এই, সকল সৎ কাজের সোয়াব দশ গুন থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত হবে কিন্তু রোজা একান্ত ভাবে আমার জন্যে, আমিই এর প্রতিদান দেব।
আল্লাহপাক কুরআনে বলেন, “ইন্নামা ইউওয়াফফাস সাবিরুনা আজরুহুম বিগঈরি হিছাব”। অর্থাৎ ধৈর্যশালীদেরকে বেহিসাব সোয়াব দান করা হবে। রোজা ধৈর্যের অর্ধেক। তাই এর সোয়াব হিসাব-কিতাবের আওতা বহির্ভূত হবে। রোজা শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্যে নবী করিম (সঃ) এর এক হাদিসই যথেষ্ট, তিনি ইরশাদ করেন- “ওয়াল্লাজি নাফছি বিইয়াদিহি লাখালুফা ফামিস- সায়িমি আত্বইয়াবু ইনদাল্লাহি মিন রিহিল মিছকি ইয়াক্বুলু আল্লাহু আ’য়যা ওয়া জাল্লা ইয়াজায়ু শাহওয়াতাহু ওয়াত্ব ‘মাহু ওয়াশারাাবাহু লি আজলি ফাসসাওমু লি ওয়াআনা আজযিবিহী” অর্থাৎ আল্লাহর কসম, যার হাতে আমার প্রাণ নিশ্চয়ই রোজাদারদের মুখের গন্ধ আল্লাহ তা’ আল্লার কাছে মিশকের চেয়েও উত্তম।
আল্লাহ বলেন, রোজাদার তার কামনা বাসনা ও পানাহার একমাত্র আমার জন্য ত্যাগ করে। অতএব রোজা আমার জন্য এবং আমি এর প্রতিদান দেব। রাসূলুল্লাহ (সঃ) আরও বলেন- নিলজান্নাতি বাবুন ইউক্বালু লাহুর রাইয়ানু লা ইয়াদখুলুহু ইল্লাছছায়্যিমুনা ওয়াহুয়া মাউয়্য’ দুন বিলিক্বায়িল্লাহি তা ‘আলা হিয়া জাযায়ু ছাওমিহী। “অর্থাৎ জান্নাতের একটি দরজার নাম ‘বাবুর রাইয়ান।
এতে রোজাদার ব্যতীত আর অন্য কেউ প্রবেশ করবে না। সায়েমকে তার সাওমের বিনিময়ে আল্লাহর দিদারের ওয়াদা দেওয়া হয়েছে। অন্যত্র আরও বলা হয়েছে, লিসসায়িমি ফারহাতানি ফারজাতুন ইনদাল ইফত্বারি ওয়া ফারহাতুন ইনদা লিক্বায়ি রাব্বাহি”। রোজাদারদের জন্য দুটি আনন্দ রয়েছে। একটি আনন্দ ইফতারের সময় এবং ওপুর আনন্দ তার পালনকর্তার দিদার লাভ করার সময়।
একটি হাদিসে বর্ণিত আছে- প্রত্যেক জিনিসেরই একটি দরজা আছে। ইবাদতের দরজা হলো রোজা। আরও বলা হয়েছে,রোজাদারের ঘুম হলো ইবাদত। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) এর বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, যখন রমজান মাস শুরু হয়, তখন জান্নাতের দরজা খোলা হয় এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। শয়তানকে শিকল দিয়ে বাধা হয়। জনৈক ঘোষণাকারী ঘোষণা করেন- যারা কল্যাণ চাও, তারা এগিয়ে এসো এবং যারা অনিষ্ট অকল্যাণ চাও, তারা সরে যাও।
পবিত্র কুরআনের এক আয়াতে বলা হয়েছে- “তোমরা অতীতদিনগুলোতে যা পাঠিয়েছো, তার বিনিময়ে আজ ইচ্ছামত জান্নাতে পানাহার করো। এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ওয়াকি (রঃ) বলেন, এখানে অতীত দিন বলতে রোজার দিনগুলোকে বোঝানো হয়েছে। কেননা, রোজার দিনে তারা পানাহার বর্জন করেছিল। রাসূলুল্লাহ (ছঃ) সংসার ত্যাগ ও রোজাকে গর্ভের বিষয় সমূহের মধ্যে এক কাতারে রেখেছেন।
সংসার ত্যাগ সম্পর্কে তিনি বলেন, আল্লাহপাক যুবক ইবাদতকারীকে নিয়ে ফেরেশতাদের নিকট গর্ব করেন এবং বলেন, হে আমার জন্য আপন বাসনা- বর্জনকারী যুবক, হে আমার সন্তোষটির জন্য যৌবন অতিবাহিতকারী যুবক; তুমি আমার কাছে ফেরেশতার মতই। পক্ষান্তরে রাসুলুল্লাহ (সঃ) রোজাদার সম্পর্কে বলেন, আল্লাহ পাক ফেরেশতাদের লক্ষ্য করে বলেন, হে আমার ফেরেশতারা; আমার বান্দাকে দেখো, সে আমার জন্য কামনা বাসনা ও পানাহার ছেড়ে দিয়েছে।
কুরআন কারীমে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ফালা তা লামু নাফছুন মা আখফা লাহুম মিন ক্বুররাতি আ’ ইউনিন জাযাআমবিমা কানু ই’ মালুন। অর্থাৎ কেউ জানে না তাদের আমলের প্রতিদান স্বরূপ তাদের জন্য কি গোপন রয়েছে, যা তাদের নয়ন শীতল করবে। পবিত্র কুরআনের এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে কোন কোন তাফসীরকার বলেন, এখানে আমল বলে রোযা বোঝানো হয়েছে।
কেননা, ধৈর্যধারণকারীদের সম্পর্কে কুরআনে আরও বলা হয়েছে, ইন্নামা ইউ ওয়াফফাস সাবিরুনা আজরুহুম বিগইরি হিছাব। অর্থাৎ ধৈর্যশালীদেরকে বেহিসাব প্রতিদান দেয়া হবে। উপরোক্ত আয়াতদ্বয় থেকে বোঝা গেল যে, ধৈর্যশীলের জন্য অগণিত স্বভাবের স্তুূপ সাজানো হবে, যা অনুমান করা যায় না। এরূপ হয়াই যুক্তিযত। কেননা, রোযা আল্লাহ তা’আলার জন্য এবং তার সাথে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার কারণে গৌরবোজ্জ্বল।
সব ধরনের ইবাদতই আল্লাহর জন্য। তবুও রোযা কাবাঘরের ন্যায় প্রাধান্য রাখে, যদিও সমস্ত জগতে আল্লাহর। রোজার এ প্রধান্য দুটি কারণ- (১) রোজা রাখার অর্থ কয়েকটি বিষয় থেকে বিরত থাকা এবং কয়েকটি বিষয় ত্যাগ করা। একটি অভ্যন্তরীণ কাজ। এতে এমন কোন আমল নেই যা চোখে দেখা যায়।
অন্যান্য ইবাদাত মানুষ দেখতে পায়। কিন্তু রোযা আল্লাহ ব্যতীত কেউ দেখেনা। (২) রোযা আল্লাহ তা’আলার দুশমনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং প্রবল হয়। কেননা, কামনা- বাসনা হচ্ছে শয়তানের হাতিয়ার, যা পানাহারের মাধ্যমে প্রবল হয়। এ কারণে এর রাসুলুল্লাহ (স:) বলেন, শয়তান মানুষের শিরা- উপশিরা বিচরণ করে। সুতরাং ক্ষুধা পিপাসার মাধ্যমে তার রাস্তাসমূহ সংকীর্ণ করে দাও।
এদিকে লক্ষ্য করে রাসূল পাক (ছ) হযরত আয়েশা (রা) কে বলেছিলেন, সব সময় জান্নাতের দরজা নাড়া দাও। আরজ করা হল, কিসের মাধ্যমে? তিনি বললেন, ক্ষুধার মাধ্যমে। যেহেতু রোযা বিশেষভাবে শয়তানের জড় উচ্ছেদ করে, আর চলার পথ রুদ্ধ এবং সংকুচিত করে, তাই রোযা বিশেষভাবে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার যোগ্য হয়েছে। কেননা, শয়তানের জড় উচ্ছেদে আল্লাহ তা’য়ালা সাহায্য করেন।
আন তান ছুরুল্লাহা ইয়ান ছুরকুম ওয়া ইউ ছাব্বিতু আক্বদামাকুম। অর্থাৎ, যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা’গুলোকে মজবুত রাখবেন। মূলতঃ বান্দার তরফ থেকে চেষ্টা শুরু করা এবং বিনিময়ে আল্লাহর তরফ থেকে সৎ পথ প্রদর্শন করা হব।
লেখক: জেলা সাংবাদিক এসোসিয়েশন সাতক্ষীরা এর যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক কাজী মারুফ হোসেন।
Leave a Reply