লিংকন আসলাম,আশাশুনি প্রতিনিধি: আশাশুনি উপজেলার ৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনের করুন দশায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা হাতে প্রাণ নিয়ে ক্লাশে বসতে বাধ্য হচ্ছে। বছরের পর বছর নতুন ভবন নির্মান না হওয়ায় অভিভাবকরা ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠিয়ে দুশ্চিন্তা ও উৎকন্ঠার মধ্যে থাকেন। ফলে শিক্ষার্থী অনুপস্থিতির হার বৃদ্ধি ও শিক্ষার্থীদের ক্লাসের প্রতি স্বাভাবিক মনোনিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। বিদ্যালয়গুলোর সংক্ষিপ্ত তথ্য নিম্নে দেওয়া হলো।
১৩৩ নং হাঁসখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় : ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলে প্রথম দিকে শিক্ষার্থী সংখ্যা ভালই ছিল। ২০০০ সালে বিদ্যালয় ভবন নির্মানের পর নতুন আগ্রহে শিক্ষার্থীরা ক্লাশে বসতে শুরু করে। বেশ ভালই চলছিল বিদ্যালয়টি। এক সময় স্কুল ভবনের ছাদের বড় বড় অংশ ধসে পড়তে শুরু করে। ওয়াল ও পিলারে ফাটল ধরে খসে পড়তে থাকে। ২০১৩ সালে বিদ্যালয় ভবন ব্যবহার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। তখন বাধ্য হয়ে ২০১৫ সালে স্থানীয় ভাবে একটি টিনসেড ছোট ঘর নির্মান করে ক্লাশ নিতে থাকে। তাতে সংকুলান না হওয়ায় পুরাতন ভবনের একটু ভাল কক্ষও ব্যবহার করা হতো। ছাদ ধসে পড়ে একজন শিক্ষক গুরুতর আহত হন। পরে আহত শিক্ষক রমেশ চন্দ্র বৈরাগী ব্রেন স্ট্রোকে মৃত্যুবরণ করেন। উঃ বলাবাড়িয়া, উঃ গাইয়াখালী, মধ্যম বলাবাড়িয়া ও হাঁসখালী গ্রামের শিক্ষার্থীরা এখানে পড়ালেখা করে থাকে। প্রধান শিক্ষক নিত্যরঞ্জন মন্ডল জানান, এপর্যন্ত ১০/১২ বার ছাদ ধসে পড়েছে, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক আহত হয়েছেন কয়েকবার। বর্ষা ও ঝড়ের সময় এই এলাকার সহস্রাধিক মানুষের আশ্রয় নেওয়ার জন্য কোন সাইক্লোন শেল্টার নেই। তাই সুষ্ঠু ভাবে স্কুল পরিচালনা, জীবন রক্ষা ও দুর্যোগের সময় আশ্রয় গ্রহনের সুযোগ করে দিতে দ্রুত সাইক্লোন শেল্টার কাম সস্কুল ভবন নির্মানের দাবী এলাকার সকলের।
১৭ নং গাইয়াখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়: ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টির ভবন নির্মান করা হয় ২০০৩ সালে। কয়েক বছর আগে থেকে ছাদ ধসে পড়ছে। ছাদ দিয়ে বৃষ্টির পানি ভিতরে পড়ে থাকে। বাধ্য হয়ে একটি টিনসেড ঘর নির্মান করে সেখানে অস্থায়ী পার্টিশান ব্যবহার করে ক্লাশ পরিচালনা করা হচ্ছে। সংকুলান না হওয়ায় একটি কক্ষ বাদে পুরাতন ভবনের বাকী কক্ষগুলো ঝুঁকি নিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে। দপ্তরী ভক্ত কৃষ্ণ মন্ডলের গায়ে একবার ছাদ ধসে পড়েছিল। কয়েকবার শিক্ষার্থীদের পাশেও ছাদ খসে পড়েছিল। প্রধান শিক্ষক উষা মন্ডল জানান, গাইয়াখালী, বলাবাড়িয়া ও ঠিকুরাবাদ গ্রামের শিক্ষার্থীরা স্কুলে পড়ালেখা করে থাকে। বর্ষার সময় স্কুলের মেঝে পানিতে তলিয়ে যায়। বছরে ৫/৬ মাস শিক্ষার্থীরা স্কুল চত্বরে নেমে খেলতে পারেনা। মাটি ভরাট ও নতুন ভবন কাম সাইক্লোন শেল্টার নির্মান খুবই জরুরী হয়ে দেখা দিয়েছে। এছাড়া দুটি ল্যাট্রিনের একটি নষ্ট, টিউবওয়েল নষ্ট, খাবার পানির সংকট, জানালা নষ্ট, বেঞ্চ ও চেয়ার সংকট এবং আসবাবপত্রের অভাব প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।
১০৫ নং নাটানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়: ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত অফিসসহ ৪টি কক্ষ বিশিষ্ট ভবন নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। ভবনের ছাদ ধসে পড়া, পিলার ও ওয়ালে ফাটল রয়েছে। যার দুটি কক্ষের অবস্থা শোচনীয়। মাঝে মধ্যে ছাদের ছোটখাট অংশ ধসে পড়লেও একবার ছুটির সময় বড় অংশ পড়েছিল। ভাগ্য সহায় থাতায় প্রাণহানি ঘটেনি। বাধ্য হয়ে একটি অস্থায়ী টিনসেড ঘর নির্মান করা হয়েছে। প্রধান শিক্ষক দীপঙ্কর মল্লিক জানান, নতুন ভবনের জন্য বারবার শিক্ষা অফিসে জানানো হয়েছে। স্কুলে যাতয়াতের পথটিও খুবই বেহাল দশা। বাউন্ডারী প্রচীর না থাকায় সমস্যা হচ্ছে। অবিলম্বে নতুন ভবন, প্রাচীর নির্মান ও রাস্তা সংস্কার প্রয়োজন।
৯২ নং কমলাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়: ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটির ভবন নির্মান করা হয় ১৯৯৪ সালে। দীর্ঘদিনের পুরনো ভবনের ছাদ ধসে পড়ছে, ওয়াল, পিলার ও কার্ণিশে ফাঁটল ধরেছে। ছাদের বড় অংশ ভেঙ্গে পড়েছিল। অল্পের জন্য প্রাণহানি ঘটেনি। টয়লেটের ছাদ ভেঙ্গে পড়েছে। ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ। কমলাপুর, খাসেরাবাদ, দাশেরাটি ও বিল নাটানা গ্রামের ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসে। কয়েকবার ভবনটি মেরামত করা হয়েছে। এখন ব্যবহার উপযোগিতা নেই। প্রধান শিক্ষক আফরোজা হোসেন জানান, ভবনের ভঙ্গুর দশার পাশাপাশি, টিউবওয়েল নষ্ট, টয়লেট সমস্যা, যাতয়াতের পথের দুরাবস্থা, প্রাচীরে ভাঙ্গন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার পরিবেশে বাধা হয়ে দাড়িয়েছে। দ্রুত নতুন ভবন, প্রাচীর, টয়লেট নির্মান করা জরুরী।
১৪০ নং পুইজালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়: ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটির ভবন নির্মান করা হয় ২০০০ সালে। ছাদ ধসে পড়ছে, ওয়াল, দরজা-জানাল ভেঙ্গে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে অফিস কক্ষ বন্ধ করে দেয়া হয়। ২০২১ সালে অস্থায়ী ২ কক্ষ বিশিষ্ট টিনসেড ঘর নির্মান করা হয়। ক্লাশ পরিচালনা ঝুঁকিপূর্ণ, বর্ষার সময় পানি পড়ে, স্কুল চত্বর পানিতে নিমজ্জিত হয়ে থাকে। কয়েকবার ছাদ ধসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পাশে পড়েছিল। এক ছাত্রের মাথা ফেটে যায়। টিউবওয়েল নেই, বৃষ্টির পানি সংরক্ষনের ট্যাংকি নষ্ট হয়ে গেছে, অভিভাবকরা বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে আগ্রহ হারাচ্ছে। প্রধান শিক্ষক চন্দ্রাবতী সরকার জানান, এলাকায় ২৫০০ মানুষের বসবাস, প্রত্যান্ত বিল, খালের মধ্যে অবস্থিত এসব এলাকার মানুষকে দুর্যোগের সময় আশ্রয় নেয়ার কোন উচু জায়গা নাই। যাতয়াত ব্যবস্থাও খুবই নাজুক। রাস্তা পানিতে তলিয়ে থাকে। এখানে একটি সাইক্লোন শেল্টার কাম স্কুল ভবন নির্মান সময়ের দাবী। তাছাড়া টিউবওয়েল, টয়লেট, রাস্তা নির্মান খুবই প্রয়োজন।
১৪৭ নং লক্ষ্মীখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়: ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলে ভবন নির্মীত হয় ২০০২ সালে। ভবনের অবস্থা ব্যবহার অনুপযোগি হয়ে পড়লে গ্রামের মানুষের সহযোগিতায় ২০২১ সালে ছাদ ভেঙ্গে টিনের ছাউনি দেওয়া হয়। ৩ বার ছাউনী ঝড়ে উড়ে গেলে আবার কোন রকমে ছেয়ে দিয়ে ক্লাশ করা হচ্ছে। ওয়াল খসে পড়ছে, চাল দিয়ে বর্ষার পানি ভিতরে পড়ে। স্কুল চত্বর পানিতে তলিয়ে যায়। পুইজালা বাজার থেকে আড়াই কিলোমমিটার রাস্তার প্রায় সবই কাচা ও চলাচল অনুপযোগি। বর্ষার সময় রাস্তা, স্কুল চত্বর পানিতে তলিয়ে থাকে। যানবাহন চলাচল করতে পারেনা, ছাত্রছাত্রীরা নৌকায় ও হাটু পানি ঠেলে স্কুলে যাতয়াত করে। পায়খানার হাউজ পানিতে তলিয়ে থাকায় একটি ব্যবহার করা যায়না। অন্যটি নষ্ট হয়ে গেছে। টিউবওয়েল না থাকায় পাশের বাড়ি থেকে পানি চেয়ে এনে খেতে হয়। দ্রুত ভবন নির্মান, টিউবওয়েল, পায়খানা ঘর নির্মান, মাঠ ভরাট, রাস্তা সংস্কার করা জরুরী।
উপজেলা শিক্ষা অফিসের সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও ক্লাস্টার অফিসার শাহজাহান আলী জানান, এসব বিদ্যালয়গুলির অবস্থা বেশ আগে থেকে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় আমাদের পরামর্শে পাশে অস্থায়ী টিনসেড ঘর নির্মান করে ক্লাশ চালান হচ্ছে। দৃষ্টিনন্দন না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেনা। কোন কোনটির ছাদ ভেঙ্গে পড়েছে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চাচ্ছেনা। আমরা ভবন চেয়ে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ বরাবর ছবিসহ তালিকা প্রেরন করেছি। এখনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
Leave a Reply