তুহিন হোসেন সাতক্ষীরা: জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বেড়েছে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে। আর মাত্রাতিরিক্ত এসব লোনা পানির দৈনন্দিন ব্যবহারের ফলে জরায়ু সংক্রান্ত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এসব এলাকার নারীরা। সেজন্য অল্প বয়সেই জরায়ু কেটে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন এই এলাকার অনেক নারীই।
সাতক্ষীরা উপকূল ঘুরে দেখা গেছে, শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ, গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী, কৈখালি ও রমজাননগরসহ উপকূলবর্তী ইউনিয়নগুলোর অধিকাংশ নারী সুন্দরবন সংলগ্ন নদীগুলোতে সাত-আট ঘণ্টা রেণু পোনা ও কাঁকড়া আহরণ করেন। উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ নারীকে সংগ্রাম করে সংসার চালাতে হয়। ফলে তাদের জরায়ুসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাতক্ষীরা উপকূলীয় এলাকার মাটি ও পানিতে বেড়েছে লবণাক্ততা। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে এলাকার মানুষ। বিশেষ করে সুন্দরবন সংলগ্ন নদীতে মাছধরা ও বনজীবী নারীরা জরায়ু সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। চিকিৎসকদের তথ্যমতে, লবণাক্ত পানির জন্য নারীদের অকাল গর্ভপাত ঘটছে। জাতীয়ভাবে দেশে জন্মের হার ১দশমিক ৩৭ শতাংশ হলেও শ্যামনগর উপজেলায় জন্মের হার শূন্য দশমিক ৮৯ শতাংশ। সাতক্ষীরা এবং উপজেলার ক্লিনিকগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কয়েক বছর ধরে জরায়ু অপারেশন বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর পাঁচ লাখ ৭০ হাজার নারী জরায়ু ক্যানসারে আক্রান্ত হন এবং প্রায় তিন লাখ ১০ হাজার নারী এই ক্যানসারে মারা যান। লবণাক্ত গলা পানিতে ভিজে সুন্দরবনের চুনা নদীতে বাগদার রেণু ধরে দিন কাটে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ জেলে পাড়ার (ছদ্মনাম) রহিমা বেগমের। তিনি বলেন, বাঘের আক্রমণে স্বামীকে হারিয়েছি। শ্বশুরবাড়ি থেকেও বের করে দিয়েছে। এখন ছেলে মেয়ে নিয়ে নদীতে মাছ ধরে কোনরকম সংসার চালায়। বনে হিংগ্র পশু আর নদীতে সাপ-কুমিরের ভয়। প্রবল গ্রোতের সঙ্গে রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কাও। সেই সঙ্গে রোগ-বালাই তো লেগেই থাকে। তারপরও লবণাক্ত পানিতে মাছ ধরতে হয়। এই ছাড়া কোন উপায় নেই।
শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের ডুমুরিয়া গ্রামের সুব্রত মন্ডলের স্ত্রী শেফালী ম-ল। দিনমজুরের কাজ করেন শেফালী। দীর্ঘদিন থেকেই ভুগছেন জরায়ুর সমস্যায়। তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রামের নারীদের সবচেয়ে বেশি জরায়ুর সমস্যা। আমরা লবণাক্ত পানিতে গোসল করি, কিন্তু পানিটা নিরাপদ নয়। তাই এই রোগ বাড়ছে।’ তিনি নিজেও রোগটিতে আক্রান্ত জানিয়ে বলেন, ‘ইন্ডিয়া, খুলনাসহ অনেক জায়গায় চিকিৎসা নিয়েছি। এখন নেকটা সুস্থ আছি, তবে পানিতে নেমে গোসল করতে পারি না, ডাক্তারের নিষেধ আছে, যতদিন বাঁচবো ততদিন পুকুরে গোসল করতে পারব না। এখনও এই অঞ্চলের নারীরা এই রোগে বেশি ভুগছে।’
স্থানীয়রা দৈনিক আজকের সাতক্ষীরা দর্পণকে বলেন, এলাকায় কাজ না থাকায় অধিকাংশ পরিবারের প্রধানরা জেলার কাজের সন্ধানে বাইরে চলে যান। কিন্তু যাওয়ার সময় প্রয়োজনীয় অর্থ বা ভরণ-পোষণের জন্য খাদ্যদ্রব্য রেখে যেতে না পারায় নারীরা বাধ্য হয়ে নদীতে রেণু ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন।
ঠিক একইভাবে চলছে বাঘ বিধবাদের জীবনও। বাঘের আক্রমণে স্বামীর মৃত্যু হলেও ভয়-ডর উপেক্ষা করে সেই সুন্দরবনেই রেণু সংগ্রহে যান বাঘ বিধবারা (বাঘের আক্রমণে নিহতদের স্ত্রী)।এভাবে নানা সমস্যার মধ্যে চলছে সাতক্ষীরার উপকূলীয় নারীদের জীবন। নেই বিকল্প কর্মসংস্থান, নেই সুচিকিৎসার ব্যবস্থাও।
সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন ডা. শেখ সুফিয়ান রুস্তম দৈনিক আজকের সাতক্ষীরা দর্পণকে বলেন, ‘সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার লবণাক্ত পানির আগ্রাসন আছে, সেখানে পানি অনেক বেশি লবণাক্ত। সুপেয় পানির কিছুটা সংকট রয়েছে। সে জন্য সারফেস ওয়াটার ব্যবহার করে থাকে সেখানকার লোকজন। তবে লবণাক্ত পানির কারণে জরায়ু ক্যান্সার হচ্ছে এ বিষয়ে আমার ধারণা নেই এটা বিশদ গবেষণা করার প্রয়োজন।
Leave a Reply