তুহিন হোসেন সাতক্ষীরা:
শীত মৌসুম আসলেই সাতক্ষীরা জেলায় গাছিরা খেজুর রসের সন্ধানে গাছ তুলতে বা গাছ কাঁটতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আগের মতো খেজুর গাছ এখন আর নেই। ইটভাঁটিতে খেজুর গাছ পোড়ানো ও জলাবদ্ধতায়সহ নানা কারনে খেজুর গাছ দিনে দিনে কমে গেছে। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে সাতক্ষীরা জেলায় ঐতিয্য খেজুরের রস ও গুড়। সে কারণে খেজুরের রস ও গুড় এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। পেশাদার গাছির সংখ্যাও কমে গেছে। খেজুর রস সংগ্রহের জন্য এখন সাতক্ষীরা জেলায় সর্বত্র গাছিরা প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গাছ কাঁটার কাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কিছুদিন আগেও বিভিন্ন এলাকার অধিকাংশ বাড়িতে, ক্ষেতের আইলে, ঝোপ-ঝাড়ের পাশে ও রাস্তার দুই ধার দিয়ে ছিল অসংখ্য খেজুর গাছ। কোন পরিচর্যা ছাড়াই অনেকটা প্রাকৃৃতিকভাবে বেড়ে উঠতো এসব খেজুর গাছ। প্রতিটি পরিবারের চাহিদা পূরন করে অতিরিক্ত রস দিয়ে তৈরি করা হতো সুস্বাদু খেজুরের গুড়। গ্রামীন জনপদে সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাবে পুকুরের পাড়ে রাস্তার ধারে পরিবেশ বান্ধব খেজুর গাছ এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। ইটভাটার রাহু গ্রাসে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার বেশি হওয়ার কারণে যে পরিমাণ গাছ চোখে পড়ে তা নির্বিচারে নিধন করায় দিনদিন খেজুর গাছ কমছেই। এখনও শীতকালে শহর থেকে মানুষ দলে দলে ছুটে আসে গ্রাম বাংলার খেজুর রস খেতে। এক সময় সন্ধ্যাকালীন গ্রামীণ পরিবেশটা খেজুর রসে মধুর হয়ে উঠতো। রস জ্বালিয়ে পাতলা ঝোলা, দানা গুড় ও পাটালি তৈরি করতেন। যার সাধ ও ঘ্রাণ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন অবশ্যই সে কথা নতুন প্রজন্মের কাছে রূপকথা মনে হলেও বাস্তব। যত বেশি শীত পড়বে তত বেশি মিষ্টি রস দেবে খেজুর গাছ। এ গাছ ৮ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত রস দেয়। এটাই তার বৈশিষ্ট্য। শীতের পুরো মৌসুমে চলে রস, গুড়, পিঠা, পুলি ও পায়েস খাওয়ার পালা। এছাড়া খেজুরর পাতা দিয়ে আর্কষণীয় ও মজবুত পাটি তৈরি হয়। এমনকি জ্বালানি কাজেও ব্যাপক ব্যবহার। কিন্তু জয়বায়ু পরিবর্তন, কালের বির্বতনসহ বন বিভাগের নজরদারি না থাকায় বাংলার ঐতিহ্যবাহি খেজুর গাছ এখন জেলা জুড়ে বিলুপ্তির পথে। এ বছর মৌশুমের শুরুতে খেজুর রস আহরণ এবং নির্ভেজাল গুড় তৈরী এবং সেটা বাজারজাত করার জন্য অনেক গ্রামে গাছিরা খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন ঠিলে, খুংগি, দড়া, গাছি দাঁ, বালিধরাসহ খেজুর গাছ কাঁটার কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন গাছিরা। শ্রমজীবি গাছিরা দৈনিক আজকের সাতক্ষীরা দর্পণকে বলেন, প্রতি বছরে খেজুর গাছ কেটে ফেলার কারণে রস ও গুড়ের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক গাছের মালিকরা খেজুর গাছ কেটে ইটভাঁটায় বিক্রয় করে ফেলেছেন। খেজুর গাছের মালিকরা জানান, আগের মতো পেশাদার গাছি (শ্রমিক) এখন নেই। অনেকে বৃদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। সারা গ্রামে এখন একজন গাছিও পাওয়া যায় না। গাছের পরিমান ও গাছির সংখ্যা কমে যাওয়া খেজুর রস ও গুড়ের দাম ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া আগে প্রতিটি গাছে এক কাঁটায় এক ভাড় করে রস হতো। কিন্তু এখন এর অর্ধেক রস হচ্ছে।
বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে শীত এলেই খেজুর রস ও গুড় নিয়ে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদেরও ব্যস্ততা বেড়ে যায় দ্বিগুন। মৌসুমের শুরুতে আলতো শীতের সোনালী সূর্য্যরে রোদেলা সকালে গাছিরা বাঁশের ডগা দিয়ে নলি তৈরীতে ব্যস্ত সময় পার করে। কেউবা আবার পাটের আশ দিয়ে দড়া তৈরীতে মগ্ন। বেলা বাড়তেই ঠিলে-খুংগি-দড়া- গাছি দাঁ বালিধরা নিয়ে গাছিরা ছুটে চলে খেজুর রস সংগ্রহের জন্য গাছ কাঁটতে। আবার ভোরে উঠে রস নামাতে কুয়াশা ভেদ করে চড়ে বেড়ায় এক গাছ থেকে আরেক গাছে। এরপর ব্যস্ততা বাড়ে মেয়েদের সকাল থেকে দুপুর অবধি সেই রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরীতে। কড়াইতে রস জালিয়ে গুড় তৈরী করতে সকাল থেকে দুপর পর্যন্ত সময় লাগে। জিরেন রস দিয়ে দানাগুড়, ছিন্নি গুলা, পাটালী তৈরী করা হয়। আর ঘোলা রস (যে রস পরেরদিন হয়) দিয়ে তৈরী হয় ঝুলা (তরল) গুড়। নলেন রসের পাটালী খেতে খুবই সুস্বাদু হয় বলে বাজারে কদর অনেক বেশী এই নলেন গুড়ের। খেজুরের রস অন্যতম একটি। শীত আসলেই আবহমান বাংলার ঘরে ঘরে শুরু হয় উৎসবের আমেজ। প্রতি ঘরে ঘরে শুরু হয় হরেক রকমের পিঠা তৈরীর আয়োজন। পিঠা তৈরীর জন্য ঢেঁকিতে চাউলের গুড়া তৈরীর মহোৎসব পড়ে যায়। বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে সন্ধ্যা হলেই একদিকে শুরু হয় কবি গান, অন্য দিকে সন্ধ্যে রস দিয়ে শুরু হয় বিভিন্ন প্রকার পিঠা পুলিসহ পায়েশ তৈরীর ধুম।
এ ব্যাপারে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা গন দৈনিক আজকের সাতক্ষীরা দর্পণকে বলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলেই খেজুর গাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে। গাছিদের খেজুর গাছ কাটার কাজটি শিল্প আর দক্ষতায় ভরা। ডাল কেটে গাছের শুভ্র বুক বের করার মধ্যে রয়েছে কৌশল, রয়েছে ধৈর্য ও অপেক্ষার পালা। এ জন্য মৌসুমে আসার সাথে সাথে দক্ষ গাছিদের কদর বাড়ে।
Leave a Reply