তুহিন হোসেন সাতক্ষীরা: একটা সময় ছিলো যখন লাঙল-গরুর হাল ছাড়া জমি প্রস্তুতের কথা ভাবাই যেত না। কিন্তু কালের আবর্তে তা হারাতে বসেছে। তবে বাংলার এ অতীত ঐতিহ্যের চিত্র এখনো দেখা যায় সাতক্ষীরা সদরের কিছু গ্রামে। কৃষকরা কাক ডাকা ভোর থেকেই মাঠের প্রান্তরে হালচাষ করত, কেউবা জমিতে বীজ বপন করত। জমির চাষের ক্ষেত্রে গরুর হাল ও মই ব্যবহার হয়ে আসছে। এতে একজন লোক ও একজোড়া গরু অথবা মহিষ থাকত। এসবই বইয়ের পুথিগাথা গল্পের মতো শোনায়। কিন্তু শীতকালীন সবজি চাষাবাদ, নিচু জমি কিংবা যান্ত্রিক পরিবহন ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে কিছু কিছু এলাকার জমি চাষাবাদ করতে এখনো লাঙ্গল-জোয়ালের প্রয়োজন হচ্ছে। কারণ সবজি খেতে ট্রাক্টর দিয়ে হালচাষ করলে মই দিয়ে সমান করা যায় না। আবার জমিতে সারিবদ্ধভাবে চারা লাগাতে লাঙ্গলের ব্যবহার করতে হয়।
অন্যদিকে, নিচু জমিতে ভারী ওজনের ট্রাক্টর কাদায় দেবে যাওয়ায় কৃষক লাঙ্গল দিয়ে চাষাবাদ করছেন। কালের আবর্তে আধুনিকতার যুগে যান্ত্রিকতানির্ভর যন্ত্র দিয়ে জমি চাষের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে দিন-দিন হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বংলার ঐতিহ্যের ধারক গরুর লাঙ্গল। তবে এ যুগেও সাতক্ষীরা সদরের কিছু কিছু এলাকায় ফুরায়নি হালের গরুর লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ। ট্রাক্টর বা পাওয়ারট্রিলারের আগমনে গরু দিয়ে হালচাষ হয় না বললেই চলে। গ্রামীণ সমাজের অনেকেই গরু পালন ছেড়ে দিয়েছেন।
কৃষি প্রধান বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে লাঙল, জোয়াল। আধুনিকতার ছোঁয়ায় হাল চাষের পরিবর্তে এখন ট্রাক্টর অথবা পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষ করা হয়। এক সময় দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে কৃষক গরু, মহিষ পালন করত হাল চাষ করার জন্য। আবার অনেকে গবাদিপশু দিয়ে হাল চাষকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে ছিলেন। আবার অনেকে, ধান গম, ভুট্টা, তিল, সরিষা, কলাই, আলু প্রভূতি চাষের জন্য ব্যবহার করতেন। নিজের সামান্য জমির পাশাপাশি অন্যের জমিতে হাল চাষ করে তাদের সংসারের ব্যয়ভার বহন করত। হালের গরু দিয়ে দরিদ্র মানুষ জমি চাষ করে ফিরে পেত তাদের পরিবারের সচ্ছলতা। আগে দেখা যেত কাকডাকা ভোরে কৃষক গরু, মহিষ, লাঙল, জোয়াল নিয়ে মাঠে বেড়িয়ে পড়ত। এখন আর চোখে পড়ে না সে দৃশ্য। জমি চাষের প্রয়োজন হলেই অল্প সময়ের মধ্যেই পাওয়ার টিলারসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে চালাচ্ছে জমি চাষাবাদ। তাই কৃষকরা এখন পেশা বদলি করে অন্য পেশায় ঝুঁকছেন। ফলে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে গরু, মহিষ, লাঙল, জোয়াল দিয়ে জমিতে হাল চাষ।
সদর উপজেলার কাশেমপুর গ্রামের কৃষক মোমিনুর রহমান ও সাংবাদিক মোঃ শহিদুল ইসলাম দৈনিক আজকের সাতক্ষীরা দর্পণকে বলেন, ছোটবেলায় হাল চাষের কাজ করতাম। বাড়িতে হাল চাষের বলদ গরু ছিল ২-৩ জোড়া। চাষের জন্য দরকার হতো ১ জোড়া বলদ, কাঠের তৈরি লাঙল, বাঁশের তৈরী জোয়াল, মই, লরি (বাঁশের তৈরি গরু তাড়ানোর লাঠি), গরুর মুখে টোনা ইত্যাদি। আগে গরু দিয়ে হাল চাষ করলে জমিতে ঘাস কম হতো। অনেক সময় গরুর গোবর জমিতে পড়ত, এতে করে জমিতে অনেক জৈবসার হতো। ক্ষেতে ফলন ভালো হতো। এখন নতুন নতুন আধুনিক বিভিন্ন মেশিন এসেছে সেই মেশিন দিয়ে এখানকার লোকজন জমি চাষাবাদ করে। তাই এখনো গরু, মহিষ, লাঙল, জোয়াল নিয়ে জমিতে হাল চাষ করা এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। গরুর লাঙল দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৬৬ শতাংশ জমি চাষ করা সম্ভব। আধুনিক যন্ত্রপাতির থেকে গরুর লাঙলের চাষ গভীর হয়। জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি ও ফসলের চাষাবাদ করতে সার, কীটনাশক কম লাগতো। দিনে দিনে এভাবেই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রামবাংলার ঐতিহ্য। আর গরুর গাড়ী শুধু দেখা যায় ১ বৈশাখ পালন করতে।
অনেকেই বাপ-দাদার সেই পুরনো স্মৃতিগুলোকে আঁকড়ে ধরে সময় পার করছেন। অতিসম্প্রতি সাতক্ষীরা সদরের কিছু কিছু মাঠে গিয়ে দেখা গেছে, বিলুপ্তপ্রায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী গরুর লাঙল দিয়ে একজন কৃষক জমি চাষ করছেন। কৃষক কওছার আলী দৈনিক আজকের সাতক্ষীরা দর্পণকে বলেন, পূর্বপুরুষের পেশা ছাড়েননি তিনি। হাল চাষের জন্য এক জোড়া বলদ গরু, লাঙল-জোয়াল, মই, ছড়ি, গরুর মুখের টোনা লাগে। গরুর লাঙল দিয়ে মাটির গভীরে গিয়ে মাটি তুলে উল্টিয়ে রাখে। ওপরের মাটি নিচে পড়ে আর নিচের মাটি ওপরে। এতে জমিতে ঘাস কম হয়,আর হাল চাষের সময় গরুর বিষ্টা সেই জমিতেই পড়ে এতে একদিকে যেমন জমিতে জৈব সারের চাহিদা পূরণ হয়, তেমনি ফসলও ভালো হয়। তিনি আরও বলেন, বলদ দিয়ে প্রতিদিন প্রায় তিন-চার বিঘা অন্যের জমি হালচাষ করি। সারা বছরই টাকার বিনিময়ে অন্যের জমিতে গরুর লাঙল দিয়ে হালচাষ করি। তবে ট্রাক্টর বা পাওয়ারটিলারের প্রচলন হওয়ায় গরু দিয়ে হাল চাষের কদর কমে গেছে। কম সময়ে বেশি জমিতে চাষে সক্ষম হওয়ায় জমির মালিকরা ট্রাক্টর বা পাওয়ারটিলার দিয়ে জমি চাষ করছে। যে কৃষকরা গরু দিয়ে হাল চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করত কালক্রমে তারা পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে গেছেন।
হালচাষি আবুল হোসেন দৈনিক আজকের সাতক্ষীরা দর্পণকে বলেন, আমাদের এলাকার অনেক জমি আছে যেগুলোর নিচু এলাকার নরম ভেজা কিংবা ছোট ছোট উঁচু-নিচু জমি আছে। যেখানে চাষ ট্রাক্টর বা পাওয়ারটিলার দিয়ে সম্ভব হয় না। তাই এসব জমিতে লাঙল-গরুর হাল ব্যবহার করি। এ ছাড়া গরুর হাল জমির গভীরে যায়, যা জমির উর্বরতার জন্য ভালো। এ জন্য এসব এলাকায় গরুর লাঙল দিয়ে হালের কদর ও চাহিদা রয়েছে।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর উপপরিচালক বলেন, হয়তোবা কোনো কোনো জায়গায় এমন জমি আছে যেখানে হাল চাষের জন্য ট্রাক্টর পাওয়ারটিলার দিয়ে সম্ভব হয় না। তাই এসব জমিতে কৃষক প্রয়োজনে লাঙল-গরুর হাল ব্যবহার করে থাকতে পারেন। তবে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের এই যুগে পশু দিয়ে হালচাষ ছেড়ে কৃষকদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে হবে।
Leave a Reply