আজকের সাতক্ষীরা দর্পণ ডেস্ক: বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নি¤œচাপের প্রভাবে কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে সাতক্ষীরা জেলার নি¤œাঞ্চলের একের পর এক গ্রাম তলিয়ে গেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। ভেসে গেছে ছয় হাজার মৎস্যঘের ও দেড় হাজার পুকুর। আমন ধানের খেত তলিয়ে গেছে। পাশাপাশি সাতক্ষীরার বেতনা নদীর বাঁধ ভেঙে ও অতিবৃষ্টিতে ৩৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। কৃষি ও মহৎ খাতে ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে প্রায় শত কোটি টাকা। ফলে মৌসুমের শুরুতে অনাবৃষ্টি আর অসময়ে অতি বৃষ্টির কারণে চাষিদের মাথায় হাত ।
চাষিরা জানান, এ বছর আষাঢ়-শ্রাবন মাসে আকাশ ছিলো বৃষ্টিহীন। সঠিক সময় বৃষ্টি না হওয়ার কারণে এ বছর সাতক্ষীরায় বীজতলা তৈরী থেকে শুরু করে আমন চাষের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে চাষিদের। অনাবৃষ্টি কারণে চাষিরা সময় মতো আমনের বীজতলা তৈরি করতে পারেন নি। ফলে সময় মতো আমন রোপন করতে পারেননি। অন্যান্য বছরে বিকল্প হিসেবে মাছ চাষ করে ক্ষতি পোষাতেন তারা। এবার যারা ধান চাষ করতে না পেরে মাছ চাষ করেছিলেন তাতে অসময়ে জল ঢেলে দিয়েছে ভাদ্রের আকাশ। এ বছর সেই জায়গা থেকেও ঘাটতি পড়ছে চাষিদের।
খোজ নিয়ে জানা গেছে, কপোতাক্ষ, বেতনা, মরিচ্চাপ নদীর তীরবর্তী ধুলিহর, ফিংড়ি, ব্রহ্মরাজপুর, লাবসা, বল্লী ও ঝাউডাঙা ইউনিয়নের বিলগুলোতে সদ্য রোপা আমন ও বীজতলা পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। পানি অপসারণের কোনো পথ না থাকায় বৃষ্টির পানি বাড়িঘরে উঠতে শুরু করেছে। সাতক্ষীরা শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রাণসায়ের খালও পানি টানতে পারছে না। প্লাবিত এলাকার কাঁচা ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে। অতিবৃষ্টির ফলে গদাইবিল, ডাইয়ের বিল, শাল্যের বিল, বিনেরপোতার বিল, রাজনগরের বিল, চেলারবিল, কচুয়ার বিল, রামচন্দ্রপুর বিল, হাজিখালি বিল, আন্ধারমানিক বিল, ঢেপুরবিল, পালিচাঁদবিল, বুড়ামারা বিল, খড়িলের বিল, আমোদখালি বিল, মাছখোলার বিলসহ জেলার অন্তত শতশত বিলে পানি থই থই করছে। এসব বিলের মাছের ঘেরও ভেসে গেছে। পৌরসভায় পানি নিষ্কাশনে যথাযথ ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় মানুষ বছরের পর বছর ধরে জলাবদ্ধতায় ভুগছে। স্বাভাবিক বর্ষণে তলিয়ে গেছে পৌরসভার ইটাগাছা, কামাননগর, রসুলপুর, মেহেদিবাগ, মধুমোল্লারডাঙ্গী, বকচরা, সরদারপাড়া, পলাশপোল, পুরাতন সাতক্ষীরা, রাজারবাগান, বদ্দিপুর কলোনি, ঘুটিরডাঙি ও কাটিয়া মাঠপাড়াসহ বিস্তীর্ণ এলাকা। গুটিকয়েক লোক পৌরসভার মধ্যে অপরিকল্পিত মাছের ঘের করার কারণে এই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে, বৃষ্টির পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগর, কালিগঞ্জ ও আশাশুনিসহ জেলার সাতটি উপজেলার নিম্মাঞ্চল। এসব এলাকার মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে রোপা আমন ধানের বীজতলা। অনেক এলাকায় বীজতলার ধানের চারায় পঁচন ধরেছে। ফলে জমিতে ধানের চারা রোপণ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। অনেকে আবার নতুন করে বীজতলা তৈরির জন্য বীজ ধান সংগ্রহের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর গ্রামের কৃষক আমিনুর রহমান জানান, তার এক বিঘা জমির ব্রি-১০ ধানের বীজতলা বৃষ্টির পানিতে পচে নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন করে আবার বীজতলা তৈরির জন্য তিনি বীজ ধান সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। কিন্তু ব্রি-১০ ধানের বীজ কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে তিনি এবার তার ৫ বিঘা জমিতে ধান চাষ করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলেন, টানা কয়েক দিনের বৃষ্টিপাতের কারণে সাতক্ষীরা জেলার ৩৫টি ইউনিয়নের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে ৩৪৪টি পুকুর এবং ৫হাজার ৭৮৮ টি ঘের ডুবে যায়। তিনি বলেন, বৃষ্টির কারণে মৎস্য খাতে ৬২কোটি ৫৫ লক্ষ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে ২৭ শ’ ৬৫ মেট্রিক টন সাদা মাছ ও ৮১৭ মেট্রিক টন চিংড়ি মাছের ক্ষতি হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক কৃষিবিদ সাইফুল ইসলাম জানান, ভারী বর্ষণের জেলার নির্মাণচল প্লাবিত হয়েছে। এতে সদরোপন করা আমন ও আবাসস্থানের জমি তলিয়ে গেছে। তিনি বলেন, জেলায় মোট ৯৮হাজার হেক্টর এর বেশি কৃষি জমে রয়েছে। এর মধ্যে ৫হাজার ৪৫২ হেক্টর কৃষি জমির ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে ১৪৮.৭৮ হেক্টর জমির ফসল। ফলে প্রায় ১০কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী বলেন, চলতি মাসের শুরু থেকে বৃষ্টি ছিল না। তবে সম্প্রতি কয়েকদিন বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই মাসে ২৯০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। গত মাস জোরে বৃষ্টিপাত হয়েছিল। গত মাসে ৯২৯ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। তিনি আরও জানান, চলতি বর্ষা মৌসুমে সাতক্ষীরায় জুন মাসে ৫৪ মি.মি এবং জুলাই মাসে ৩১৪ মি.মি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। গত বছর জুন মাসে ২৯২ মি. মি এবং জুলাই মাসে ২২৯ মি. মি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল।
Leave a Reply