কাজী মারুফ হোসেন সাতক্ষীরা:
মহানবি (সা.) কবি ও কবিতার জন্য ভুবনখ্যাত এক জনপদে (৫৭১ খ্রিষ্টাব্দে) জন্মেছিলেন। সময়টা ছিল খুব অস্থির। কিন্তু তিনি ছিলেন পাপ-পঙ্কিল অন্ধকার পৃথিবীতে আলোক বিচ্ছুরিত এক দ্যুতিময় ব্যক্তিত্ব। কি মেধায়, কি মননে, কি ভাষায়, কি আচরণে, সর্বত্র অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। মহানবি (সা.)-এর মা হজরত আমেনা ছিলেন একজন স্বভাব কবি। রাসূলের পিতা আব্দুল্লাহর মৃত্যুর পর তিনি কয়েকটি শোকগাঁথা গেয়েছিলেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। কাব্য এবং সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা তার এক অনন্য সৃজনশীল রুচির পরিচয় বহন করে। রাসূল (সা.)-এর উত্থানের সময় আরবে বেশিরভাগ কাব্যের প্রধান বিষয় ছিল যুদ্ধবিগ্রহ, অশ্লীলতা, কাম, ক্রোধ, সম্পদ লুণ্ঠন, অন্যের বিরুদ্ধে উসকানি, গোলযোগ সৃষ্টি, বিপদে ফেলা ইত্যাদি।
সে যুগে কাব্যচর্চা এমন এক রূপ পরিগ্রহ করেছিল যে, খ্যাত-বিখ্যাত ও কাজের মেলাকে কেন্দ্র করে কবিদের মধ্যে চলত বড়ত্বের লড়াই বা কবিতাযুদ্ধ। প্রতিবছর যে সাতজন কবির কবিতা শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় উন্নিত হতো, সে সাত কবির কবিতা মিসরের মিহি কাপড়ে সোনার হরফে লিখে কাবার দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হতো এবং এর সংকলনের নামকরণ করা হতো ‘আস সাবউল মুয়াল্লাকা’। সাবউল মুয়াল্লাকার সাতজন শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন-ইমরাউল কায়েস, তুরফা, জুহায়ের ইবনু আবু সালমা, লবিদ, আমর ইবনু কুলসুম, আনতারা ইবনু শাদ্দাদ, নাবিগা ইবনু জুবিয়ানি প্রমুখ।
কবিতায় যখন আরবের কাব্যবাজার রমরমা, তখনই রাসূল (সা.) লাভ করেন নবুওয়াত-রেসালত। নাজিল হতে থাকে মহাগ্রন্থ পবিত্র কুরআনুল কারিম। যা ছিল মানব বোধের উৎস, অন্ধকারে আলোর ঔজ্জ্বল্য এবং কাব্যরীতির এক অনুপম উপমা। আরবের ভিনধর্মী কবি-সাহিত্যিকরা শুরু করেন চেঁচামেচি। তিনি নিরক্ষর, কবি-সাহিত্যিক কিছুই নন, তার মুখনিঃসৃত মহাসাহিত্যের কুরআনিক কথাগুলো কোথায় পান? এ কথাগুলোর সামনে আমাদের উচ্চমার্গের কবিতাগুলো তুলে ধরাই যাচ্ছে না! কুরআনের চ্যালেঞ্জ-‘শুধু তোমরা কেন, সমগ্র পৃথিবী থেকে তোমাদের সহযোগিতার জন্য কবি-সাহিত্যিকদের একত্রিত করে দেখ! কুরআনের মতো ছোট একটি সূরা লিখতে পার কিনা?’(সূরা বাকারা : ২৩)।
শিল্পসাহিত্যের প্রতি বিশেষ করে, কবিতার প্রতি আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর ছিল এক সহজাত আকর্ষণ। ওহুদ যুদ্ধের প্রথম দিকে মহানবি (সা.) হাতের একটি আঙুলে ব্যথা পেলে হঠাৎ গেয়ে ওঠেন-‘হাল আনতে ইল্লা ইসবাউন দামিতে/ ওয়া ফি সাবিলিল্লাহি মা লাকিতে’। অর্থ : ‘হে আঙুলি! তুমি তো একটি আঙুল বৈ কিছুই নও।/ সুতরাং যা কিছু হয়েছে তা আল্লাহর রাস্তায় হয়েছে। (অনুশোচনা ও দুঃখ কিসের?)
খন্দক যুদ্ধে সাহাবিরা যখন পেটে পাথর বেঁধে আত্মরক্ষার জন্য পরিখা খনন করছিলেন, তখন তাদের কষ্ট দূর করতে সান্ত্বনা প্রদানে মহানবি (সা.) আবৃত্তি করতে থাকেন-‘আল্লাহুম্মা লা আয়শা ইল্লা আইশুল আখিরাহ/ ফাগফিরলি আনসারা ওয়াল মুহাজিরাহ/ আল্লাহুম্মা লা খায়রা ইল্লা খাইরুল আখিরাহ/ফাবারিক লি ফিল আনসারে ওয়াল মুহাজিরাহ’(সহিহ বোখারি, ২য় খণ্ড পৃ-৫৮৮)। হুনায়েনের যুদ্ধ ময়দানে সৈন্যদের উদ্দেশে আবৃত্তি করতে থাকেন-‘আনা নাবিউন লা কাজিব/ আনা ইবনু আবদুল মুত্তালিব’ (সহিহ বোখারি ২য় খণ্ড পৃ : ৬১৭)। এছাড়া সহিহ বোখারিতে মহানবির আওড়ানো অনেক কবিতার কথা উল্লেখ আছে। এ কবিতাগুলো ছিল মহানবি (সা.)-এর স্বরচিত কবিতা। কবি হাসসান ইবনু সাবিত ছিলেন রাসূল (সা.)-এর সভাকবি। মহানবি (সা.) যখন গভীরভাবে উপলব্ধি করলেন, জাহেলি যুগের ওইসব কবির মোকাবিলা একমাত্র কবিতা দিয়েই সম্ভব, তখনই তিনি কাব্য এবং সাহিত্যচর্চার প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা দিতে শুরু করেন।
Leave a Reply