সাতক্ষীরা থেকে: স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণবঙ্গের সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। ঢাকা থেকে দেশের দক্ষিণের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াতে সময়ও লাগছে কম। এতে বেড়েছে ভোমরা স্থলবন্দরের গুরুত্ব। তবে সাতক্ষীরাবাসির দাবি পণ্য পরিবহন খরচ কমাতে ও ভোমরা বন্দরের উপর চাপ কমাতে ১৯৬৫ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া সাতক্ষীরার কালিগঞ্জের বসন্তপুর নৌ-বন্দরটি দ্রæত চালু করার দাবি সাতক্ষীরা জেলাবাসীর।
বসন্তপুর থেকে ভোমরা স্থলবন্দরটি ৪৮ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। বসন্তপুর নৌবন্দরটি পুনরায় চালু হলে ভারত ও বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বর্ণদ্বার উন্মোচিত হবে এবং সেই সঙ্গে পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটবে। এরই মধ্যে বসন্তপুর পোর্ট এলাকায় প্রশাসনের সহযোগিতায় রিভারড্রাইভ ইকোপার্ক নামের একটি পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। যেখানে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণ পর্যটকের সমাগম ঘটে।
কালীগঞ্জ, শ্যামনগর, আশাশুনি ও দেবহাটা উপজেলার অধিকাংশ মানুষ চিকিৎসা, ভ্রমণ, বাণিজ্যসহ নানান কারণে ভারতে যাতায়াত করেন। নৌবন্দরটি পুনরায় চালু হলে দূরবর্তী ভোমরা স্থলবন্দরে না গিয়ে সহজেই বসন্তপুর নৌবন্দর ব্যবহার করতে পারবেন।
বসন্তপুর নৌ-বন্দর বিষয়ক সাব কমিটির আহবায়ক শেখ এজাজ আহমেদ স্বপন জানান, সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার বসন্তপুর নৌ-বন্দরটি একটি পুরাতন নৌ-বন্দর। এই বন্দরটি সীমান্তের ইছামতী, কালিন্দি ও কাঁকশিয়ালী নদীর মোহনায় (ত্রিমোহিনী) অবস্থিত। ভারত সীমান্তে হিঙ্গলগঞ্জের সঙ্গে বসন্তপুরে নৌ-বন্দর চালু ছিল। এ বন্দরটি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করতো। এ বন্দরে মথুরেশপুর ও ভাড়াসিমলা ইউনিয়ন ছাড়াও সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকার হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান ছিল। কিন্তু ১৯৬৫ সালের দিকে বন্দরটি বন্ধ হয়ে যায়।
তিনি আরো বলেন, নৌ বন্দর টি দ্রুত চালু করার বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি দিয়েছেন। নৌ-বন্দরটি দ্রুত চালু হলে ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে দুই দেশের মধ্যে ব্যবসার পথ সুগম হবে। নৌ-পথে আমদানি-রপ্তানি পরিবহন খরচ কম হওয়ায় ব্যবসায়ীরা বসন্তপুর নৌ-বন্দরটি ব্যবহারে বেশী আগ্রহী হবেন। বন্দরটি চালু হলে সাতক্ষীরা জেলার বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। এই এরাকার উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। ফলে পদ্মা সেতুর সুফল পাওয়া আমাদের জন্য সহজ হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভিশন ২০৪১ রূপ প্রকল্প বাস্তবায়নে এবং উন্নয়নের মহাসড়কে আমরা যুক্ত থাকতে পারবো। বসন্তপুর নৌ-বন্দরটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের স্মৃতিবিজড়িত একটি স্থান। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, জাতির পিতার ভ্রাতা শেখ আবু নাসের ও তাদের পরিবারের সদস্যরা অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সময় এই যায়গা দিয়ে ভারতে গমনাগমন করেন এবং অবস্থান করেন।
সাতক্ষীরার মানুষের প্রাণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এই এলাকার গুরুত্ব বিবেচনায় স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়কে আধুনিক নৌবন্দর স্থাপনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেন। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পর সাতক্ষীরা জেলার ২২ লক্ষ মানুষ আশায় বুক বেঁধেছে। বসন্তপুর নৌ-বন্দর দ্রুত চালু হলে সাতক্ষীরার অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে এবং বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে দেশের অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটবে।
বর্তমান সময় মুক্ত বাজার অর্থনীতির সময়, উৎপাদনকারী তার পণ্য সামগ্রী যথাযথ ভাবে যেন বাজারজাত করতে পারেন সে বিষয়টি বিশেষ ভাবে নিশ্চিত করা না গেলে উৎপাদনকারী লোকসানের মুখে পড়বে। বাংলাদেশ বর্তমান সময়ে উৎপাদনে অনেক অনেক দূর এগিয়ে চলেছে আর উৎপাদনমুখি বাংলাদেশ তার উৎপাদিত শিল্প পণ্য ও কৃষি পণ্য বিশ্ববাজারে রপ্তানীর মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে চলেছে। উৎপাদন করা পণ্য সামগ্রী যথাযথ সময়ে রপ্তানী এবং বাজার জাত করনের জন্য চাই সুষম পরিবেশ এবং পরিস্থিতি। তবে বন্দরটি হতে হবে অতি উত্তম। বাংলাদেশের অতি পুরাতন এবং প্রাক্তন নৌ বন্দর হিসেবে ইতিহাসের অংশ হিসেবে নিজেকে জানান দিচ্ছে সাতক্ষীরর কালিগঞ্জের বসন্তপুর নৌ বন্দর। আমাদের দেশের এক সময়ের অর্থনীতি তথা ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছিল বসন্তপুর নৌ বন্দর। ব্যাপক ভিত্তিক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, এলাকার উন্নয়ন ত্বরান্বীত হবে, কেবল আমদানী রপ্তানীর ক্ষেত্র বিস্তৃত হবে তা নয়, বসন্তপুর নৌ বন্দর চালু হলে অভ্যন্তরীন বাণিজ্য অনেক দুর এগিয়ে যাবে, নৌ পথের যাতায়াত যোগাযোগ এবং পণ্য বহনে যথাযথ ভূমিকা পালন করবে।
এবিষয়ে কালিগঞ্জের বাসিন্দা বিশিষ্ঠ সাহিত্যিক ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক গাজী আজিজুর রহমান জানান, নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। রাজা প্রতাপাদিত্যের কাকাতো ভাই রাজা বসন্ত রায়ের নাম অনুসারে অধুনা কালিগঞ্জের বসন্তপুর গ্রামের নামকরণ করা হয়। অনুকুল পরিবেশের কারণে পাকিস্তানের শুরুতে এলাকার উন্নয়ন ও সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থানের কথা মাথায় রেখে তৎকালিন পাকিস্তান সরকার এ নৌবন্দরটি চালু করেন। ক্রমশঃ এ বন্দরের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বেড়ে যায়। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পর্যন্ত এ বন্দরের কার্যক্রম চালু ছিল। সেই সময় নৌ-পথ ব্যবহার করে শত শত মানুষ হান্ডলোড সিস্টেমের মাধ্যমে মালামাল নিয়ে এপার-ওপার যাতায়াত করতো। এ বন্দর দিয়ে আমদানী-রপ্তানি হতো বিভিন্ন প্রকার পোশাক, পিতল-কাসা, হাড়ি-পাতিল, ফল ফলাদি, মুদি সামগ্রী পেয়াজ, রসুন, মশলা এবং সাতক্ষীরায় উৎপাদিত মাছ। সে সময় কাস্টমস ও ইমেগ্রেশন বিভাগের রমরমা কার্যক্রম থাকলেও পাক-ভারত যুদ্ধ শেষ না হতেই অনানুষ্ঠানিক ভাবে বন্দরের সকল কার্যক্রম বন্দ হয়ে যায়। তবে শুল্ক বিভাগের কার্যক্রম আজো চালু আছে। চালু রয়েছে বসন্তপুর তহশীল অফিসটি। বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ হলেও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত নদীপথে মানুষ এপার-ওপার করতো। বর্তমানে সব কিছু বন্ধ রয়েছে।
Leave a Reply