স্টাফ রিপোর্টার: সাতক্ষীরার কালিগঞ্জের বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সভাপতি সুমন সরদারের বিরুদ্ধে বাঁশতলা মাছের সেটে র্যাব এর অভিযানে মাটির তলায় পুঁতে ফেলা ৭শ’ কেজি পুশকৃত বাগদা চিংড়ির বড় অংশ উত্তোলন করে ব্লিচিং পাউডার দিয়ে শোধন করে তা পুণরায় বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তার এড়াতে সুমন সরদার ও তার সহযোগীরা প্রশাসনে দেন দরবার শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। কালিগঞ্জের গোয়ালঘেষিয়া নদীর উপর বাঁশতলা ব্রীজ এলাকার সাইফুল ইসলাম ও আব্দুল খালেকসহ কয়েকজন মাছ ব্যবসায়ী জানান, ব্রীজ এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধের পাশে প্রায় ১০ বছর যাবৎ মাছের আড়ৎ গড়ে উঠেছে। এ আড়তে ২২ টি কাটা আছে। মাছের আড়ত পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে ফতেপুর গ্রামের নুরুজ্জামান লালু ও নীলকণ্ঠপুর গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা নুরু সরদারের ছেলে বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন শ্রমিকলীগের সভাপতি সুমন সরদার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
মাছের আড়ৎ তৈরির পর থেকে অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে বাগদায় অপদ্রব্য পুশ করে তা ঢাকার কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করা হয়। এক সময় পুলিশের হস্তক্ষেপে পুশ বন্ধ থাকলেও প্রায় এক বছর ধরে আবারো তা চলমান রয়েছে। পুশ চালু রাখতে থানাকে ম্যানেজ করার নামে সুমন সরদারে প্রতি মাসে আড়ৎদারদের কাছ থেকে ৯০ থেকে ৯৫ হাজার টাকা আদায় করে থাকেন। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করেন বন্দকাটি গ্রামের মোহাম্মদ আলীর ছেলে আমিরুল ইসলাম। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৫ সেপ্টেম্বর সকাল ১১টার দিকে র্যাব এর বিশেষ অভিযানে পুশকৃত ৭০০ কেজি বাগদা চিংড়ি জব্দ করা হয়। আটক করা হয় চারজন মাছ ব্যবসায়িকে। বিকেলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে চার মাছ ব্যবসায়ীর প্রত্যেককে ৬ মাসের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। কোরোসিন ও প্রেট্রোল ঢেলে চিংড়িতে আগুন লাগিয়ে র্যাব এর গাড়ির তলায় কিছু চিংড়ি নষ্ট করা হয়। পরে সকল চিংড়ি মাটির নীচে পুঁতে ফেলা হয়। নৌবাজপুর গ্রামের আব্দুস সালাম, বন্দকাটি গ্রামের সাইফুল ইসলামসহ কয়েকজন জানান, আমিরুল ইসলাম ও সুমন সরদারের উপস্থিতিতে ও তাদের নির্দেশনায় ১৫ সেপ্টেম্বর শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে কোদাল দিয়ে মাটি সরিয়ে প্রায় ৬ কুইন্টাল মাছ তুলে ফেলেন নবীননগরের এশারুল ইসলাম, মশরকাটির আমীর আলীর ছেলে আনারুল ইসলাম, নীলকণ্ঠপুর গ্রামের সাত্তার সরদারের ছেলে আব্দুল হাকিম, তার ভাই ঢাকার মাছ ব্যবসায়ি সালাম, নীলকণ্ঠপুর গ্রামের দিলদার আলীর ছেলে মাসুম, আব্দুল মালেকের ছেলে আবু মুছা, নীলকণ্ঠপুর গুচ্ছগ্রামের দেলদার আলীর ছেলে ভাড়ায় চালিত মটর সাইকেল চালক হযরত ও বন্দকাটি গ্রামের নজীবর রহমান খোকাসহ ১০/১২ জন। পরে ওই মাছ আবু মুছার ছেলের টাইলস বসানো মেঝেতে ফেলে ব্লিচিং পাউডার দিয়ে পরিশোধন করে তাতে মৎস্য আড়তের নিজস্ব মিলের বরফ দেওয়া হয়। পরদিন সকাল ১১টার দিকে নতুন করে পরিশোধন করে নতুন বরফ দিয়ে নতুন বাগদার সঙ্গে মিশিয়ে ঢাকায় পাঠান আড়ৎদার সালাম ও হাকিম। সালাম ও সাইফুল আরো জানান, খবর পেয়ে কালিগঞ্জ থানার পুলিশ সদস্য সেলিম ও খলিল শুক্রবার দিবাগত রাত একটার দিকে একটি ওয়ান টেষ্ট মটর সাইকেলসহ হযরত ও নজীবর রহমান খোকাকে বাড়ি থেকে তুলে থানায় নিয়ে যান। খবর পেয়ে সুমন সরদার, আনারুলসহ চিংড়ি উত্তোলনের কাজে জড়িতরা আত্মগোপন করে জেলা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ পর্যায়ের নেতার কাছে ছুঁটে যান। যদিও ১৬ সেপ্টেম্বর রাত ৯টার দিকে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় হযরত ও নজীবর মুক্তি পান। দু’লাখ টাকার দফার রফা শেষে প্রকাশ্যে আসেন সুমন সরদার ও আনারুলসহ কয়েকজন। এদিকে বিষ্ণুপুর ই্উনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল হক জানান, ১৬ সেপ্টেম্বর সকালে তিনি বাঁশতলা মাছের সেটে যেয়ে মাটির তলায় পুঁতে ফেলা বাগদা চিংড়ি তুলে বিশেষ কায়দায় ঢাকায় পাঠানো হয়েছে মর্মে জানতে পারেন। যেটি ছিল ওই দিনকার বাঁশতলা বাজারের হট কেক।
কালিগঞ্জ উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা নাজমুল হুদা জানান, খবর পেয়ে তিনি ১৬ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টার দিকে বাঁশতলা মাসের সেট এলাকা পরিদর্শনে যান। পুশকৃত নষ্ট করা মাটির নিচে পুঁতে ফেলা মাছ উত্তোলন করার বিষয়ে অনেকেই তার কাছে অভিযোগ করেন। তিনি সেখানকার ছবি তোলেন। চিংড়ি পুঁতে ফেলার পর সেখানকার মাটির যে উচ্চতা ছিল চিংড়ি উত্তোলনের পর সেখানকার মাটির উচ্চতা অনেক কম পরিলক্ষিত হয়। তিনি বিনষ্টকৃত চিংড়ি মাটির নিচ থেকে তুলে পুণরায় বিক্রির সত্যতা থাকার বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করেন। তবে মঙ্গলবার বিকেল চারটা পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে কিনা তা তিনি জানাতে পারেননি।
এদিকে গোয়ালঘেষিয়া নদীর ব্রীজ এলাকার কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, সাত বছর ধরে সুমন সরদার ও কামাল মেম্বর গোয়ালঘেষিয়া নদীর ব্রীজের তলার জেলা পরিষদের খেয়াঘাটের খাস কালেকশানের নামে ছোট ও বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ফতেপুর গ্রামের মুর্শিদ কারিকরের ছেলে রবিউল ইসলাম ও একই গ্রামের বদর কলুর ছেলে আনছারের মাধ্যমে অবৈধভাবে বার্ষিক ১২ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করে থাকেন। তারা আরো জানান, গত ১৫ আগষ্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে সুমন সরদারের নেতৃত্বে বাঁশতলা বাজার ও মাছের সেটে ব্যাপক চাঁদাবাজি করা হয়েছে। দাবিকৃত চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় অনেকেই সুমন সরদার ও তার সহযোগীদের হাতে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন শ্রমিকলীগের সভাপতি সুমন সরদার জানান, তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সঠিক নয়। সাক্ষাতে তিনি বিস্তারিত জানাবেন।
এ ব্যাপারে কালিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামুন রহমান সাংবাদিকদের জানান, পুশকৃত বাগদা চিংড়ি মাটির নিচ থেকে তোলার অভিযোগে হযরতসহ দুইজনকে ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়। অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
Leave a Reply